ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবর্তক হাজী শরিয়তুল্লাহঃ সংক্ষিপ্ত জীবনী

হাজী শরীয়তুল্লাহ ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা এবং ইসলামী পণ্ডিত ছিলেন, যাকে সবাই চেনেন তাঁর ফরায়েজী আন্দোলনের কারণে। তিনিই সর্বপ্রথম নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। তিনি মুসলমানদের জীবনকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা কেবল ইসলামী রীতিনীতি এবং আচার-অনুষ্ঠান পালন এবং সত্যিকারের ইসলামও অনুসরণ করতে পারে। ঘুমন্ত বাঙালি মুসলমানের এই জাগরণ তিতুমীর এবং দুদু মিয়ার মতো তাঁর উত্তরসূরিদের ভবিষ্যত কাজের জন্য ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।

জন্ম ও ছেলেবেলাঃ

শরিয়তউল্লাহ ১৭৮১ সালে বর্তমান মাদারীপুরের শিবচর এর শামাইল গ্রামে তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল জলিল তালুকদার ছিলেন একজন কৃষক। ছোটবেলায় তার মা মারা যান। এরপর ৮ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা গেলে তাঁর দায়িত্ব নেন চাচা আজীম আদ-দ্বীন। চাচা তাঁকে আদরে যত্নে লালন করতে থাকেন। চাচা তাঁর শাসনে কড়াকড়ি করতেন না। তাঁর যখন ১২ বছর বয়স চাচা একবার তাঁকে কোন কারণে তিরষ্কার করেন। রাগ করে শরিয়তুল্লাহ কলকাতা চলে যান।

কলকাতায় পড়াশোনাঃ

কলকাতায় গিয়ে শরিয়তুল্লাহ মৌলানা বাশারাত আলীর কাছে কুরআন শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। সেখানে তিনি ২ বছরে আরবি ও ফার্সী ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। এরপর তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদ যান চাচার কাছে। সেখানে তাঁর চাচা আশিক মিয়াঁ ডিসট্রিক্ট কোর্ট অফিসে অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এখানে পরবর্তী এক বছর আরবি ও ফার্সী ভাষার চর্চা করেন তিনি। এরপর চাচা চাচী তাঁকে নিয়ে শামাইলে গ্রামের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্যে নৌকায় চড়ে রওনা হন। পথে ঝড়ের কবলে তাদের নৌকাটি ডুবে যায় এবং চাচা ও চাচী দুজনেই মারা যান। শরীয়তুল্লাহ এই দুর্যোগে খুবই দুঃখ পান। তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন তাঁর শিক্ষক বাশারত আলীর কাছে।

এই সময়ে তার শিক্ষক বাশারত আলী, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তিনি মক্কা ও মদিনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত  নেন। শরীয়তুল্লাহও তার সাথে থাকার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ওস্তাদের সাথী  হয়ে শরিয়তুল্লাহ ১৭৯৯ সালে মক্কা চলে যান।

মক্কায় পড়াশোনাঃ

মক্কায় মক্কায় প্রথম দুই বছর শরীয়তুল্লাহ স্থায়ীভাবে বসবাসকারী  বাঙালি মুসলমান অভিবাসী মাওলানা মুরাদের বাড়িতে অবস্থান করেন। মুরাদের সাথে থাকাকালীন শরীয়তুল্লাহ আরবি সাহিত্য এবং ফিকাহ অধ্যয়ন করেছিলেন।

এর পরবর্তী ১৪ বছরের সময়কাল জুড়ে শরীয়তুল্লাহ তাহির আল-সুম্বল মাক্কি নামে বিখ্যাত একজন বিশিষ্ট হানাফি আইনজ্ঞের অধীনে পড়াশোনা করেন। শরীয়তুল্লাহ এবার কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ইসলামী দর্শন পড়ার জন্য মাক্কির কাছে অনুমতি চাইলেন। সেখানে তিনি লাইব্রেরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন।

দেশে প্রত্যাবর্তনঃ

শরিয়তুল্লাহ ইসলাম ও আরবি ভাষার দক্ষ একজন পণ্ডিত হিসেবে আরব থেকে বাংলায় ফিরে আসেন ১৮১৮ সালে। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি আরবে কাটিয়ে এসেছিলেন। তখন তার লম্বা দাড়ি ছিল এবং সবসময় পাগড়ি পরতেন। তিনি যখন প্রথম শামাইলে তার চাচা আজিম আল-দীনের বাড়িতে যান, তখন তার এত পরিবর্তন হয়েছিল যে, কেউ তাকে চিনতে পারেনি।

কিছুদিন পর, তার চাচা মারা যান এবং কোনও ছেলে উত্তরাধিকারী না থাকায় পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেন বলে জানা যায়। শরিয়তুল্লাহ তার চাচার জানাজায় অংশ নিতে পারেননি, কারণ স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাথে তার মতবিরোধ তৈরি হয় ইসলামী জানাজা পদ্ধতি নিয়ে।

ফরায়েজী আন্দোলন এর সূত্রপাতঃ

একবার শরীয়তুল্লাহ মাগরিবের নামাজের আযান দিলেন। কিন্তু কোন নামাযী নামায পড়তে আসেনি। মুসলমানরা নামায আদায়ের মত ইসলামের মূল শিক্ষাগুলোর প্রতি উদাসীন ছিল।

তিনি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যখন তিনি দেখতে পান যে, অনেক মুসলমান কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং হিন্দু-প্রভাবিত অনুশীলনে জড়িত, যা তাঁর কাছে ছিল  ইসলামের শিক্ষা বিরোধী। এরপর তিনি বাংলা ও ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ইসলাম এর মূল শিক্ষা প্রচার করা শুরু করেন।

১৮১৮ সালে শুরু হওয়া তাঁর এই প্রচার ফারাইজি আন্দোলন নামে পরিচিতি  লাভ করে। প্রথম দিকে শরীয়তুল্লাহ বাংলার অভিজাত মুসলমানদের কাছ থেকে প্রচুর বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারা তাকে আইন এর মাধ্যমে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। তার প্রচারমূলক কার্যক্রমের প্রাথমিক ব্যর্থতার পরে, শরীয়তুল্লাহ মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

ধারণা করা হয়, এই ভ্রমণটি ১৮১৮ এবং ১৮২০ এর মধ্যে কোন সময়ে হয়েছিল। শরীয়তুল্লাহ বিশ্বাস করতেন যে বাংলায় ইসলামকে বিশুদ্ধ করার তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল কারণ, তিনি তার শিক্ষক তাহির আল-সুম্বল মাক্কির কাছ থেকে এ কাজ করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমতি চাননি। তার শিক্ষক তাকে সুফিবাদের কাদিরিয়াত তরিকাতে দীক্ষিত করেন এবং আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ দিয়ে ১৮২০ সালে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠান।

১৮১৮ সালের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হলেও, ১৮২১ সালে যখন তিনি দ্বিতীয়বার তাঁর চেষ্টা শুরু করেন, ফরায়েজি আন্দোলন বাংলায় জনপ্রিয় ও সুপরিচিত হয়ে ওঠে। এটি মাদারীপুর থেকে অল্প সময়েই ঢাকা, ফরিদপুর, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি মুসলিম সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত অংশ কৃষক ও কারিগরদের মধ্যে তার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ।

 

তাঁর মতবাদ ও শিক্ষাঃ

শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল হানাফি মতবাদে ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাঙালি মুসলমানদের করণীয় ঠিক করা। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী ফরয কাজগুলো ঠিকমত পালন করা।

তিনি তাওহীদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের প্রতি সঠিক বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি তাঁর সাথে কোন মিথ্যা দেব-দেবীকে শরীক করা থেকে বিরত থাকার উপর জোর দিয়েছিলেন।

এ ছাড়া তিনি মুসলমানদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বোধ এবং সাম্যবাদের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি জাতিগত বৈষম্যের নিন্দা করতেন, যা মুসলিম সমাজকে দূষিত করেছিল।

তিনি অমুসলিম প্রতিবেশীদের রীতিনীতি দ্বারা মুসলিম সমাজে প্রবেশ করা অসংখ্য অ-ইসলামী রীতিনীতি এবং পৌত্তলিক আচার পালনের তীব্র নিন্দা করেছিলেন। আরবে দেশের ওয়াহাবি সংস্কারের পরে, তিনি ফাতিহা, উরস এবং মিলাদের পালন, পীর পূজা, কবর পূজা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছিলেন, যা উপমহাদেশের মুসলমানদের জনপ্রিয় সামাজিক আচার ছিল। এবং এখনও রয়েছে এবং এগুলিকে তিনি বিদ’আত (অধার্মিক এবং পাপী উদ্ভাবন) হিসাবে ঘোষণা করে তাদের বিলুপ্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।

বাংলার আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে এর প্রভাবঃ

বাংলার মুসলমানরা হিন্দু জমিদার ও বৃটিশ বণিক দ্বারা শোষিত হচ্ছিল। হাজী শরীয়তুল্লাহ এই স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। এভাবে তিনি ফারাইজি আন্দোলন শুরু করেন মুসলমানদের মধ্যে জিহাদি মনোভাব তৈরি করার জন্য যাতে তারা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে পারে।

হেদায়ায় উল্লিখিত মুসলিম আইন বিশেষজ্ঞদের ধ্রুপদী মতবাদ অনুসরণ করে তিনি ব্রিটিশ ভারতকে দার-আল-হারব (একটি শত্রু রাষ্ট্র) হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে না পারার প্রেক্ষাপটে তিনি ঘোষণা করেন যে, যেহেতু মুসলিম শাসন নেই তাই বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য জুমা ও ঈদে জামাতে নামাজ আদায় বৈধ নয়। রক্ষণশীল উলামারা এর তীব্র বিরোধীতা করেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন যে, এই নামাজগুলি বন্ধ করে দিলে মুসলিম সমাজ বিভক্ত এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁর সমসাময়িক ধর্মীয় প্রচারক মাওলানা করমত আলী জৌনপুরী এই বিষয়ে তার তীব্র বিরোধিতা করে হাজী শরিয়তুল্লাহকে বাংলার খারিজি হিসাবে নিন্দা করেছিলেন।

হাজী শরীয়তুল্লাহ ঘোষণা দেন যে, কুরআনের আদেশ অনুযায়ী নিজের প্রচেষ্টার ফল ছাড়া মানুষের কিছুই প্রাপ্য নয়। তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে সৃষ্ট জমিদারদের চাষীদের দ্বারা উত্পাদিত কৃষি ফসলের উপর কোনও অধিকার নেই। তিনি তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দেন যে তারা যেন জমিদারদের দ্বারা আরোপিত কোনও রকম কর বা খাজনা না দেয়। আগেই বলা হয়েছে তাঁর এই মতবাদ অভিজাত মুসলমান, হিন্দু জমিদার ও বৃটিশ নীলকরদের দ্বারা প্রচণ্ড বিরোধীতার সম্মুখীন হয়।

বিশেষ করে ঢাকার জমিদারেরা তাঁর এত বিরোধীতা করেন যে, একবার ঢাকার নয়াবাড়িতে উভয়পক্ষের দাঙ্গা বেধে যায়। ফরিদপুরে কৃষি অস্থিরতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে শরিয়তউল্লাহকে একাধিকবার পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়।

মৃত্যুঃ

হাজী শরিয়তুল্লাহ ১৮৪০ সালে ৫৯ বছর বয়সে তার নিজ গ্রাম শামাইলে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে তার বাড়ির উঠোনে সমাহিত করা হয়। তার কবর বন্যায় ভেসে গেলেও তার সমাধিশিলালিপি পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি দ্বারা সংরক্ষিত রয়েছে।

তাঁর মৃত্যুর পর ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তার একমাত্র পুত্র মুহসিনউদ্দিন আহমদ। তিনি পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের অবস্থার উন্নতির জন্য কাজ চালিয়ে যান এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সংস্কার করেন।

হাজী শরিয়তউল্লাহর সম্মানে মাদারীপুর জেলার পালং থানার নামকরণ করা হয় শরীয়তপুর জেলা।

শরীয়তুল্লাহ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত সুপরিচিত এবং স্বীকৃত। ফারাইজি আন্দোলন সম্পর্কে স্কুল এর পাঠ্যপুস্তকে ও পাশাপাশি ইসলামী ঐতিহাসিক বইগুলিতে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ ১৯৯৩ সালের ১০ মার্চ তার স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

২০০৫ সাল শিবচরে মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়কের আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর ৪৫০ মিটার (১,৪৮০ ফুট) সেতুর নামকরণ হাজি শরিয়তুল্লাহ করা হয়েছে।

Add a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।