বসনিয়া যুদ্ধ : পূর্ব ইউরোপের ইতিহাসের বৃহত্তম মুসলিম গণহত্যা (পর্ব-১)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদিদের হলোকাস্টের পর ইউরোপের সবচেয়ে বৃহত্তম গণহত্যা সংগঠিত হয়ে বসনিয়ার মুসলমানদের উপর। এর ইতিহাস জানতে হলে একটু পিছন থেকে শুরু করতে হবে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে বড় বহুজাতিক দেশ ছিল যুগোস্লাভিয়া। দেশটির নামের অর্থ স্লাভদের দেশ হলেও এই দেশটি ছিল সার্ব, ক্রোট, বসনিয়াক, মেসিডোনীয়, স্লোভেন ও মন্টেনিগ্রিন – এই ৬টি জাতির একটি ফেডারেশন রাষ্ট্র। ফিল্ড মার্শাল জোসেপ ব্রোজ টিটোর নেতৃত্বাধীন দেশটিতে জাতিগত বিরোধ বা ধর্মীয় উগ্রতা ছিল না। কিন্তু ঝামেলার শুরু হয় তার মৃত্যুর পর। মার্শাল টিটো তার বহুজাতিক রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য দেশটির ভবিষ্যৎ শাসনপ্রণালী সম্পর্কে বিস্তৃত পরিকল্পনা মৃত্যুর আগেই রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর পুরো যুগোস্লাভিয়া জুড়ে জাতিগত বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিভিন্ন জাতির রাজনীতিবিদরা ধর্মীয় বিদ্বেষকেও নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
এমতাবস্থায় যুগোস্লাভিয়ায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রজাতন্ত্রগুলো একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের ২৫ জুন যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রটি ভেঙে মেসিডোনিয়া, স্লোভেনিয়া, মন্টেনিগ্রো, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা (এটি সম্মিলিত রাষ্ট্র, তবে সংক্ষেপে বসনিয়া নামেই পরিচিত), ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়া নামক ৬টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এদের মধ্যে মন্টেনিগ্রো সার্বিয়ার সাথে ফেডারেল ইউনিয়ন সরকার গঠন করে। বাকিরা পৃথকভাবে থাকার জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু সার্বিয়া চাচ্ছিলো নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রেখে সবাইকে নিয়ে ফেডারেশন রাষ্ট্র গড়তে। তাই দেশটির সাথে স্লোভেনিয়ার (১৯৯১), ক্রোয়েশিয়ার (১৯৯১-১৯৯৫) বসনিয়া-হার্জেগোভিনা (১৯৯২-১৯৯৫) ও সর্বশেষ (১৯৯৮-৯৯) সালে কসোভোর সাথে যুদ্ধ চলে। খেয়াল করে দেখুন বসনিয়া ও ক্রোয়েশিয়াতে একই সময়েই যুদ্ধ চলছিল। আজকের আর্টিকেলটি বসনিয়া যুদ্ধের গণহত্যাকে কেন্দ্র করে লেখা। তবে শুরুতেই পাঠকদের ঘটনার গভীরতা বুঝাতে তৎকালীন বলকান অঞ্চলের জটিল রাজনৈতিক সমীকরণকে সহজ ও সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করবো।
ঝামেলার শুরুটি হয়েছিল সার্বিয়ানদের হাত ধরে। ১৯৯২ সালে বসনিয়া–হার্জেগোভিনা ছিল একটি বহুজাতিক প্রজাতন্ত্র। দেশবাসীদের মধ্যে ৪৪% ছিল বসনিয়াক, ৩২.৫% ছিল সার্ব, ১৭% ছিল ক্রোট এবং বাকিরা অন্যান্য জাতিভুক্ত মানুষ। অর্থাৎ এটি ছিল মিনি যুগোস্লাভিয়া! বসনিয়াকরা ছিল মুসলিম, সার্বরা অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং ক্রোটরা ক্যাথলিক খ্রিস্টান। (মুসলমানদের শিয়া-সুন্নির মতো এই দুধরণের খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে পার্থক্য রয়েছে) বসনিয়া–হার্জেগোভিনা প্রজাতন্ত্রটির ঘোষিত রাষ্ট্রপতি আলিয়া ইজেতবেগোভিচ ছিলেন মুসলিম বসনিয়াক সম্প্রদায়ের। স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া প্রাক্তণ যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তিনিও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তবে তিনি গণভোটের মত গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করেছিলেন। উক্ত গণভোটে দেশটির বেশিরভাগ লোক (বসনিয়াক-ক্রোট জনগণ) স্বাধীনতার পক্ষে ভোটদান করে।
ইউরোপের দেশগুলো তাই দেশটির স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু বসনিয়ান সার্ব জাতিগোষ্ঠীর লোকজন এই গণভোট বর্জন করে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে থাকা বিহারীদের মতো সার্ব জাতির লোকেরা সার্বিয়ার সাথে থাকার জন্য বসনিয়ার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়েছিল। ফলে বসনিয়া সরকার ও বসনিয়ান সার্বদের মাঝে সে বছরের এপ্রিলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। উক্ত ৩২.৫% সার্ব জনগণ বসনিয়া–হার্জেগোভিনার ভূমিতেই ‘রিপাবলিকা স্রপস্কা’ নামক আরেকটি অবৈধ কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে ৪৯% ভূমি দখল করে নেয়। এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সমর্থন ছিল পাশের স্বাধীন রাষ্ট্র সার্বিয়ার। অর্থাৎ বসনিয়ান সার্ব ও সার্বিয়ান সার্ব জাতিগতভাবে এক হওয়ায় তারা পরস্পরের মিত্র ছিল। রিপাবলিকা স্রপস্কা এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাদোভান কারাদজিচ। গণহত্যার জন্য তাকে ও তার জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ কে ‘বসনিয়ার কসাই’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। পাশের দেশ সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচও গণহত্যায় পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
সার্ব বিদ্রোহীদের তুলনায় বসনিয়ান সেনাবাহিনী ছিল বেশ দুর্বল। তারা শুরুতেই বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হয়। এসময় জাতিসংঘ দেশটিতে অস্ত্র রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ন্যাটোর তেমন স্বার্থ না থাকায় তারাও শুরুতে কড়াভাবে পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করেনি।
অপরদিকে যুগোস্লাভিয়ার পতনের পর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে বসনিয়ান সার্বরা ছিল আগে থেকেই শক্তিশালী। তার উপর সার্বিয়ান সার্বদের সহায়তা পেয়ে তারা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। এদিকে বসনিয়ান ক্রোট জাতির লোকজন প্রথমে বসনিয়ান মুসলিম সরকারের পক্ষেই ছিল। গণভোটে তারাও স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের সুযোগে উক্ত ১৭% ক্রোট জাতির লোকজন মিলে ‘হার্জেগ–বসনিয়া ক্রোয়েশীয় প্রজাতন্ত্র’ নামের রাষ্ট্র গঠন করে! অর্থাৎ বসনিয়া–হার্জেগোভিনার স্বাধীনতার পরপরই তিন টুকরো হয়ে গেছে!! জাতিগত বিভেদের মাঝে যোগ হয়েছে ধর্মীয় বিরোধ।
অর্থোডক্স খ্রিস্টান সার্ব, মুসলিম বসনিয়ান বা ক্যাথলিক খ্রিস্টান ক্রোট – কেউ কাউকেই দেখতে পারতো না। নবগঠিত বসনিয়ার ক্রোট রাষ্ট্রটি বসনীয় মুসলিম সরকার ও বসনীয় সার্ব বিদ্রোহী – উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে একই সময়ে যুদ্ধ আরম্ভ করে। পাশের স্বাধীন দেশ ক্রোয়েশিয়া নিজেও যুদ্ধে জর্জরিত থাকলেও বসনীয় ক্রোট জাতির লোকদের সার্বিকভাবে সহায়তা করে। অর্থাৎ ঐ মুহূর্তে বসনিয়ান সার্বদেরকে পাশের দেশ সার্বিয়া ও বসনিয়ান ক্রোটদেরকে পাশের দেশ ক্রোয়েশিয়া সরাসরি সাহায্য করছিল। কিন্তু জাতিসংঘের অস্ত্র আমদানি নিষেধাজ্ঞায় থাকায় বসনিয়ান মুসলিমদের সাহায্যে তেমন কেউ ছিল না। এসময় ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান, সৌদি আরব প্রভৃতি দেশ তাদের সাহায্যে গোপনে এগিয়ে আসে। প্রথমে আমেরিকা বিরোধিতা করলেও পরে গোপনে বসনিয়াক মুসলিমদের সহযোগিতা করে।
এই যুদ্ধে সংঘটিত হয় মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায়। বসনিয়া যুদ্ধে তিনপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় গণহত্যার স্বীকার হয়েছিল সেখানকার মুসলিমরা। এই যুদ্ধ ও গণহত্যায় ৩১,৫৮৩ জন বসনিয়াক মুসলিম, ৪,১৭৯ জন বসনীয় সার্ব ও ২,৪৮৪ জন বসনীয় ক্রোট জাতির বেসামরিক লোক নিহত হয়। এছাড়া প্রায় ১২,০০০ থেকে ২০,০০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয় যাদের বেশিরভাগই ছিল বসনিয়াক মুসলিম। ব্যাপক গণহত্যার জন্য মূলত দায়ী ছিল বসনীয় সার্বরা। তারা মুসলিম বসনিয়াকদের পাশাপাশি আংশিকভাবে বসনীয় ক্রোটদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালায়৷
অবশ্য বসনীয় মুসলিম সরকারও সার্ব ও ক্রোটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ করেছিল। আবার বসনীয় ক্রোটরা নিরাপরাধ মুসলিম বসনিয়াক ও বসনীয় সার্ব জনগণদের হত্যা করেছিল। অর্থাৎ তিনপক্ষই একে অপরকে কমবেশি হত্যা করেছিল। তবে বেশি সহিংসতার শিকার হয় বসনিয়াক মুসলিম জনগোষ্ঠীর লোকজন। অবশেষে ১৯৯৪ সালে বসনীয় সরকার (মুসলিম বসনিয়াক) ও বসনীয় ক্রোটদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, এবং তারা সম্মিলিতভাবে রিপাবলিকা স্রপস্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য সার্বিয়া বাদে স্রপস্কার মিত্র ছিল রিপাবলিক অব সার্বিয়ান ক্রাজিনা ও ওয়েস্টার্ন বসনিয়া নামের দুটি অস্বীকৃত রাষ্ট্র।
সার্বিয়ান ক্রাজিনা ছিল বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার অভ্যন্তরেই একটি সার্ব বিদ্রোহী অঞ্চল যারা কিছুদিন আগেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। অন্যদিকে রাজনৈতিক সমীকরণের মারপ্যাঁচে বসনিয়া–হার্জেগোভিনা প্রজাতন্ত্রটির ঘোষিত রাষ্ট্রপতি আলিয়া ইজেতবেগোভিচ হলেও তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফিকরেত আব্দিচ ছিলেন পপুলার ভোটে জেতা প্রার্থী। তিনি গৃহযুদ্ধের সুযোগে তার অনুসারীদের নিয়ে ‘ওয়েস্টার্ন বসনিয়া’ নামে বসনিয়ার ভিতরেই আরেকটি মুসলিম অঞ্চল গঠন করেন। তিনি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে সার্বদের সাথে হাত মিলিয়ে বসনিয়াকে চার টুকরো করতে ভূমিকা রেখেছিলেন।
সারায়েভো গণহত্যা :
রাদোভান কারাদজিচ ছিলেন বসনীয় সার্বদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা। সার্ব রাষ্ট্রের টিকে থাকার জন্য গণহত্যাকে তিনি নৈতিক দায়িত্ব মনে করতেন। এজন্য মুসলিম বসনিয়াক ও ক্রোটদের পাইকারি হারে হত্যা শুরু করেন। গৃহযুদ্ধ শুরু হতেই বসনিয়ার ক্রোটরা ক্রোয়েশিয়ায় পালিয়ে যেতে শুরু করে। বসনিয়াক মুসলিমদের স্বল্পসংখ্যক কসোভো, আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া, হাঙ্গেরিসহ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ক্রমাগত সার্বদের বসনিয়ান এলাকা দখলের কারণে বাকিরা পালানোর সুযোগ পায়নি।
মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সারায়েভোকে ৪৪ দিনব্যাপী অবরুদ্ধ রেখে নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়। এখানে প্রায় প্রায় ১,৫০০ শিশুসহ ১০ হাজারের মতো মুসলিম হত্যা করা হয়। তবে এটাই শেষ নয়।
রাদোভান কারাদজিচ দু দুটি বড় ধরনের গণহত্যার মূল কারিগর। তার নির্দেশে বসনিয়ার আরেক মুসলিম অধ্যুষ্যিত অঞ্চল স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার নেতৃত্ব দেন কারাদজিচের বসনীয় সার্ব সেনাবাহিনীর জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ।
ক্রাভিকা গণহত্যা :
এটি স্রেব্রেনিৎসার প্রথম বড় ধরনের গণহত্যা। তবে এটি মূল গণহত্যার বাইরের একটি একক বড় ঘটনা। ৭ জানুয়ারি, ১৯৯৩ সালে স্রেব্রেনিৎসার ক্রাভিকাতে প্রায় ৬ হাজার বসনিয়াক নাগরিকদের গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ১০০০ থেকে ১৫০০ বসনিয়াক পুরুষকে ক্রাভিকা ফুটবল ফিল্ডের একটি গুদামে মেশিনগান, গ্রেনেড এমনকি আরপিজি মেরে হত্যা করা হয়। ডাচ শান্তিরক্ষী বাহিনীরা সার্বদের আক্রমনের মুখে পিছু হটে যাওয়ায় সার্বরা এই অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এটি বসনিয়া যুদ্ধে একদিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা।
স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের বিরুদ্ধে জার্মান হলোকাস্টের পর দ্রুততম সময়ের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ধরণের হত্যাকাণ্ড হচ্ছে বসনিয়ার স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে পূর্ব বসনিয়ার জেপা, স্রেব্রেনিৎসা ও গোরাজদে শহর তিনটি বসনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ এই এলাকাগুলোকে ‘মুক্তাঞ্চল’ ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করেছিল। এই কাজে দায়িত্ব পালন করছিল নেদারল্যান্ড সেনাবাহিনীর ব্যাটালিয়ন। ১৯৯৫ এর ১১ জুলাই, জেনারেল রাতকো ম্লাদিচের বসনীয় সার্ব সেনাবাহিনী স্রেব্রেনিৎসায় ঢুকে পড়ে। সেখানে অবস্থানরত ডাচ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সামনেই বসনিয়াক বেসামরিক পুরুষ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করার জন্য আলাদা করে বন্দি করা হয়। তাদেরকে বাসে করে বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে বসনিয়াক নারী ও কন্যা শিশুদেরকে বাসে তুলে বসনীয়-নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার আগে এই নারীদের অনেকেই ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ণের শিকার হন। এসময় সার্বদের হাতে ক্রোট নারীরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।
১১ জুলাই, ১৯৯৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত স্রেব্রেনিৎসায় মোট ৮,৩৭২ জনকে বসনিয়াক মুসলিমকে হত্যা করা হয়। এদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ ও ছেলেশিশু। সার্বদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে যেন এরা লড়াই করতে না পারে সেজন্য এই কাজ করেছিলেন জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। কারাদজিচ এবং মিলোসেভিচের মূল লক্ষ্য ছিলো স্রেব্রেনিৎসা থেকে নন-সার্ব জাতিদের পুরোপুরি বিতাড়িত করা। ফলে প্রায় ২০ হাজার বসনিয়াক মুসলিম নারী এবং কন্যা শিশুকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া বহুসংখ্যককে গ্রেফতার করা হয়।
স্রেব্রেনিৎসায় এত বড় গণহত্যার খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হতেই নিন্দার ঝড় ওঠে। সেগুলোকে উপেক্ষা করে সে মাসেই বসনীয় সার্ব মিলিশিয়ারা জেপা দখল করে নেয়। এখানেও তারা গণহত্যা ও বিতাড়ন চালায়। এর কয়েকদিন পরই সারায়েভোর এক জনবহুল বাজারে সার্বরা একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ব্যাপক বসনিয়াক বেসামরিক মুসলিমের মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশেষে নাড়া দেয়। আগস্ট মাসে গণহত্যা বন্ধে ইউরোপের সবচেয়ে বড় সামরিক সংগঠন নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) ও জাতিসংঘের দেওয়া একটি হুঁশিয়ারিকে অগ্রাহ্য করে সার্বরা। ফলে বসনীয় সার্বদের গণহত্যায় সহায়তা করায় রাষ্ট্র সার্বিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ দেয় জাতিসংঘ। রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকায় এতদিন ধরে
দেশটির প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচ অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করছিলেন। এবার বসনিয়ার সার্বদের সামরিক অবস্থানগুলোতে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় ন্যাটো। একই সঙ্গে তারা বসনীয় সরকার ও ক্রোয়েশীয় বাহিনীদের সঙ্গে মিলে সার্বদের বিরুদ্ধে গ্রাউন্ড অপারেশন শুরু করে।
ন্যাটোর সহযোগিতা পাওয়ায় সার্বরা দ্রুত পরাস্ত হতে শুরু করে। জাতিসংঘের কঠোর বাণিজ্য অবরোধে সার্বিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে সার্বদের নেতা মিলোসেভিচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সমঝোতা করতে সম্মত হন। ১৯৯৫ সালে ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো রাজ্যের ডেটনে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এতে সার্ব জাতির পক্ষে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মেলোসেভিচ, বসনিয়াক মুসলিমদের পক্ষে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ইজেতবেগোভিচ এবং ক্রোট জাতির পক্ষে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ফ্রানজো তুজমান যোগ দেন। ব্যাপক আলোচনার পর স্থির হয় একটি ফেডারেল বসনিয়া রাষ্ট্র গঠন করা হবে যার এক অংশ হবে একটি ক্রোয়াট-বসনিয়াক ফেডারেশন ও অপর অংশ সার্ব প্রজাতন্ত্র। আঞ্চলিক সরকার যার যার অঞ্চল ও কেন্দ্রীয় সরকার পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করবে। শাসন ব্যবস্থাটি খুবই জটিল হলেও সকলের জন্য ভালো ছিল। ডেটন চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ হলে পরবর্তীতে এই অঞ্চলে শান্তিরক্ষার জন্য সেখানে ন্যাটো সৈন্যদের মোতায়েন করা হয়।