ব্যাটল অফ ইসমাইলিয়া (পর্ব-২) : মিশরীয় প্যারাট্রুপাররা ঠেকিয়ে দিয়েছিল বিশাল ইসরাইলি বাহিনীকে
পরদিন ইসরাইলি কর্নেল আমনন রেশেফের আর্মার্ড ব্রিগেড জেনারেল এরিয়েল শ্যারনের ডিভিশনে যুক্ত হয় এবং তিনি হেডকোয়ার্টার থেকে ইসমাইলিয়া আক্রমন শুরু করার প্রকৃত নির্দেশ পান। তার কর্নেল ড্যানি ম্যাট সেরাবেয়াম আক্রমণ করে আবারও ব্যর্থ হন। কর্নেল ইসমাইল আজমীর মিশরীয় প্যারাট্রুপার রেজিমেন্ট ও শাইকা কমান্ডো গরুপ মিলে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পরে জেনারেল শ্যারন কর্নেল রেশেরফের ট্যাংক বহরকে আক্রমণে পাঠান। মিশরীয়রা প্রচন্ড আক্রমণের মুখে পিছু হটে এবং প্রথম ব্রিজটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়। ইসরাইলিরা এতে হতভম্ব হয়ে যায়। ইসমাইলিয়ার পতন ঠেকাতে আরবরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বুঝতে পেরে তারা নতুন কৌশল করে। তারা মিশরীয়দের একটি রেডিও ইন্টারসেপ্ট স্টেশন খুঁজে বের করে ধ্বংস করে দেয়। কর্নেল আজমী আইন গাসিন গ্রামের পাঁচ কিঃমিঃ উত্তরে বাহিনী নিয়ে সরে যান এবং ৮৯তম ব্যাটালিয়নকে সেরাবিয়াম রামপার্ট স্ট্রংপয়েন্ট ছেড়ে তুসকান স্ট্রংপয়েন্টে পজিশন নিতে বলেন। ইসরাইলিরা রামপার্ট দখল করে সুয়েজ খালের ওপাড়ে আর্টিলারি হামলা শুরু করে।
কমান্ড ক্রাইসিস :
সেদিন রাতে আরো দুই ব্যাটালিয়ন শাইকা কমান্ডো নিয়ে কর্নেল ওসামা ইব্রাহিম কায়রো থেকে আসেন। আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে তাকে স্পেশাল অপারেশন হিসেবে ইসরাইলি ভাসমান ব্রিজগুলো ফ্রগম্যান (ডুবুরী) হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিতে বলা হয়। জেনারেল সাজলি ও জেনারেল খলিল এই খবর পেয়ে আঁতকে উঠেন। কেননা তারা থার্ড ডিভিশনকে পূর্বপাড় থেকে সরিয়ে ফেলেছেন! কমান্ডোরা ব্রিজ উড়িয়ে দিলে ইসরাইলিরা মরিয়া হয়ে আবার ব্রিজ বানাবে তা নিশ্চিত। তিনি মিলিটারি পুলিশ পাঠিয়ে কর্নেল ওসামাকে থামান।
হেডকোয়ার্টারকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করা হলে জেনারেল খলিলকে উল্টো তিরস্কার করা হয় এবং কর্নেল ওসামাকে ব্রিজ উড়িয়ে দিতে পুনরায় পাঠানো হয়। কমান্ড ক্রাইসিস ঠেকানোর জন্য জেনারেল সাজলী মিশরের রাজধানী কায়রোতে আর্মি হেডকোয়ার্টারে ফিরে যান।
কারণ তিনি যে থার্ড ডিভিশনের আর্মার্ড ব্রিগেডকে উইথড্র করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটি হেডকোয়ার্টার নাকচ করে দেয়। ফলে মিশরীয় আর্মার্ড ব্রিগেড দুইদিন ধরে অলস বসে ছিল। বোকার মতো অবিশ্বাস্য ভুল করায় আরবদের অনেকেই মাথামোটা বলে গালি দিয়ে থাকে।
অপরদিকে ইসরাইলি সাইডেও কমান্ড ক্রাইসিস দেখা দেয়। সাউদার্ন ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল স্যামুয়েল গোনেন ও জেনারেল চেইম বার-লেভ (শ্যারনের কমান্ডিং অফিসার) জেনারেল শ্যারনকে পূর্ব দিকে সেনা পাঠিয়ে ইসরাইলি করিডোরকে চওড়া করার নির্দেশ দেন। কিন্তু শ্যারন তার চেয়ে ফুল স্কেল এট্যাক করে ইসমাইলিয়া দখল করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু সিনিয়র অফিসারদের চাপে মাত্র পাঁচটি ট্যাংক ও স্বল্প সংখ্যক সৈন্য দিয়ে হামলা চালান এবং যথারীতি ব্যর্থ হন। তাকে আবার হামলা চালাতে চাপ দেন গোনেন ও বারলেভ। একই র্যাঙ্কের অফিসারের অর্ডার শ্যারন মানছেন না দেখে তাদের সাথে যুক্ত হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডেভিড এলাজার। কিন্তু মেজর জেনারেল এরিয়েল শ্যারন তার সাথেও তর্ক শুরু করেন! ইসমাইলিয়া দখল করতে পারলে সুয়েজ খালের এপাড়ে-ওপাড়ে থাকা মিসরীয় সেকেন্ড ও থার্ড আর্মি ডিভিশনকে সহজেই হারানো সম্ভব হবে – এটি বুঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সিনিয়র অফিসারদের চাপ অব্যাহত থাকায় শ্যারন এবার কমান্ড বাইপাস করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে যান! মন্ত্রী ‘মশে দায়ান’ শ্যারনকে তার মতো কাজ করার স্বাধীনতা দেন। এই ঘটনায় ভবিষ্যতের ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের কূটনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দুইপক্ষের কমান্ড ক্রাইসিসে যুদ্ধ আরো লম্বা হয়।
তৃতীয় দিন সকালে এয়ারফোর্সের সহায়তায় শ্যারন এবার তিন ব্রিগেড সেনা নিয়ে হামলা চালান। তুসকান এবং আইন গাসিনে ব্যাপক হামলার মুখে পড়েন কর্নেল আজমী। তিনি দ্বিতীয় ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে ও বাঁধ খুলে ইসরাইলিদের পানিতে ভাসিয়ে দিতে অনুমতি চান। জেনারেল খলিল সিভিলিয়ানদের খাবার ও কৃষিকাজের কথা ভেবে কড়া ভাবে নিষেধ করেন। কিন্তু ইসরাইলি ট্যাংক এত দ্রুত এগিয়ে আসছিল যে সেটি করা ছাড়া কর্নেল আজমীর কোনো উপায় ছিল না। ব্রিজ ও বাঁধ উড়িয়ে দেয়ায় পুরো কৃষিক্ষেত ডুবে যায়। পানিতে ইসরাইলি ট্যাংকের কামানগুলো পর্যন্ত ডুবে যায়। দৃশ্যটি দেখে ইসরাইলিদের মনে হচ্ছিলো নীলনদের ফাঁদে পড়েছে ফেরাউনের বাহিনী। ফলে তারা বিকল্প পথে পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করে। এদিকে তুসকানে প্রচন্ড বিমান ও আর্টিলারি হামলায় মরতে মরতে এক ব্যাটালিয়ন মিশরীয় প্যারাট্রুপারদের মধ্যে আর মাত্র ১২০ জন টিকে আছে। তাদেরকে রাতের বেলা নাফিসা গ্রামে পশ্চাদপদসরণ করতে বলা হয়।
তারা যাওয়ার পথে কর্নেল ওসামার কমান্ডো গরুপের সাথে দেখা হয়ে যায়। তিনি তখন ব্রিজ ধ্বংস করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইসরাইলিরা তার মিশন সম্পর্কে কোনো না কোনো ভাবে জানতো (সম্ভবত মোসাদের কাজ)। কর্নেল ওসামা ইসরাইলিদের এমবুশের শিকার হয়ে আর্টিলারি সাপোর্ট চান। কিন্তু রেডিও স্টেশন ইসরাইলিদের দখলে থাকায় তারা সেটি জ্যাম করে রেখেছিল এবং আরবীতে কথা বলে তার পজিশন জানতে চান। ওসামা বুঝতে না পেরে তার পজিশন রেডিওতে ইসরাইলিদের বলে দেয় এবং তারা কমান্ডোদের উপরেই আর্টিলারি হামলা শুরু করে। কর্নেল ওসামা তার বাহিনী নিয়ে নিকটস্থ আমবাগানে আশ্রয় নেন। মধ্যরাতে তিনি জীবিত বাকি কমান্ডোদের নিয়ে জেনারেল খলিলের কাছে হাজির হন। এবার আর্মি হেডকোয়ার্টার ব্রিজ উড়ানোর মিশন বাতিল করে কর্নেল ওসামাকে জেনারেল খলিলের কমান্ডে নিযুক্ত করে ইসমাইলিয়া প্রতিরক্ষার কাজে সাহায্য করতে বলেন। অর্থাৎ বাংলা প্রবাদে যাকে বলে ‘গাধা পানি খায় ঘোলাটে করে’। প্রথমেই জেনারেল সাজলীর পরামর্শ মানলে এমনটি হতো না।
ফাইনাল ফাইট :
চতুর্থ দিন অর্থাৎ ২১ অক্টোবর সকালে আবারো হামলা শুরু করে ইসরাইলিরা। ব্যাপক আর্টিলারি গোলাবর্ষণের মুখেও যথারীতি মাটি কামড়ে পড়ে মিশরীয়রা। তবে রাতের বেলা তারা তুসকান থেকে পিছু হটে ইসমাইলিয়া স্টেডিয়ামে জড়ো হয়। কারণ ইসমাইলিয়াতে মিশরীয় আর্টিলারি ইউনিট ইসরাইলি ট্যাংক ব্রিগেডের কাছে ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে জেবেল মারিয়াম ডিফেন্স লাইন হলো ইসমাইলিয়া শহরে ঢুকার সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। জেনারেল খলিল এবার ইসরাইলিরা যেন ইসমাইলিয়া ক্যানাল ট্যাংক নিয়ে অতিক্রম করতে না পারে সেজন্য আশেপাশের তিনটি সেনানিবাস থেকে কয়েক ব্যাটালিয়ন আর্টিলারি (২৮০ টি কামান) ধার করে সেখানে মোতায়েন করেন। এছাড়া শেষ ব্রিজটি দখল ঠেকাতে সেখানে আটটি এন্টি ট্যাংক মিসাইল ইউনিট (মোট ৪৮টি মিসাইল) মোতায়েন করা হয়। সৈনিকদের প্রতি জেনারেল খলিলের অর্ডার ছিল “hold Jebel Mariam to the last bullet and the last man”।
সেনাদের পাশাপাশি স্থানীয় কৃষক-যুবকদেরদের নিয়ে গঠিত মিলিশিয়া বাহিনী রাস্তা খুঁড়ে এন্টি ট্যাংক ডিফেন্স ট্রেঞ্চ তৈরি করতে শুরু করে। ব্যাপক যুদ্ধের আশঙ্কায় বেসামরিক লোকজন এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে। সন্ধ্যার দিকে তিনদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে ইসরাইলিরা। তীব্র মিসাইল হামলায় তারা ব্রিজ দখলে নিতে ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে ব্যাপক মিশরীয় আর্টিলারি হামলায় তারা সামনেই এগুতে পারছিলো না। জেনারেল খলিল সিঙ্গেল ব্যারাজে সবগুলো আর্টিলারি থেকে একযোগে ফায়ারিং এর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বাধ্য হয়ে পরদিন সকালে মিশরীয় আর্টিলারি পজিশনে বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল এয়ারফোর্সের যুদ্ধবিমান। সকাল দশটায় আবারো ইসরাইলি গ্রাউন্ড ফোর্স একযোগে জেবেল মারিয়াম, নাফিসা, আবু এত-ওয়া প্রভৃতি এলাকায় হামলা শুরু করে। বিশেষ করে আবু এত-ওয়াতে থাকা শাইকা কমান্ডোদের এমবুশে চারটি ট্যাংক ও ৫০ জন নিহত হওয়ায় ইসরাইলিরা পিছু হটে। নাফিসাতে তখন ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। তিনটি ট্যাংক, দুটো হাফট্রাক হারালেও ইসরাইলিরা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করছিল। মিশরীয়রা ২৪ জন শাইকা কমান্ডো হারালেও এরিয়েল শ্যারনের ইউনিটকে পাল্টা হামলা করে পিছু হটতে বাধ্য করেছিলেন।
যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি :
সেদিন রাতেই জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কার্যকর হয়। জেবেল মারিয়ামে তখন ইসরাইলিরা সর্বশেষ মিশরীয় পজিশনের মাত্র ২০-৩০ মিটার দূরে ছিল। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ। মাঝে ভুলক্রমে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হলেও দুইদিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ফলে ইয়োম কিপুর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে যতটা সহজে মিশরকে পরাজিত করেছিল, এবার ততটাই কঠিন হয়েছে ইসরাইলের যুদ্ধ। ব্যাটল অফ ইসমাইলিয়াতে ট্যাক্টিক্যাল পরাজয় ঘটলেও পুরো যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিক বিজয় কিন্তু ইসরায়েলের। জেনারেল শ্যারন পরে বলেছিলেন যে সাউদার্ন কমান্ড তার কাজে ব্যাঘাত না ঘটালে তিনি তিন দিনে ইসমাঈলিয়ার পতন ঘটিয়ে যুদ্ধের ইতি ঘটাতেন। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে শ্যারন রাজনৈতিকভাবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন যা পরে তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে কর্নেল ইসমাইল আজমী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে ইসমাইলিয়ার পতন ঠেকালেও অর্ডার অমান্য করে দ্বিতীয় ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়ায় তার কোর্ট মার্শাল হয়।
ইসমাইলিয়া যুদ্ধের ফলাফলে ইসরাইলিরা বুঝতে পারে সামরিকভাবে আরবদের সাথে ভবিষ্যতের যুদ্ধে জেতা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই আরব দেশগুলোর সাথে একে একে শান্তিচুক্তি করা শুরু করে। এই কাজটি শুরু হয় মিশরের মাধ্যমে। ইসরাইল মিশরের সিনাই উপত্যকা ও ইসমাইলিয়ার দখলকৃত এলাকা ফেরত দেয়। কিন্তু সিরিয়ার গোলান মালভূমি নিজেদের দখলে রাখে। ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে প্রথম আরব দেশ হিসেবে মিশর ইসরাইলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এজন্য মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভে করেন (১৯৮১ সালে একই কারণে খুন হন) এরপরই বিভিন্ন আরব দেশের সাথে একটু একটু করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার তৎপরতা শুরু করে ইসরাইল যার ফলাফল আজ তারা ভোগ করছে। ফিলিস্তিনের জমি দখল ও তাদের উপর নির্যাতনের তেমন প্রতিবাদ করছেনা আরব দেশগুলো।