ব্যাটল অফ সুয়েজ : মিশরীয় মিলিশিয়াদের হাতে ইসরাইলের লজ্জাজনক পরাজয় (পর্ব-২)
ইসরাইলি ট্যাংক ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাহুম জাকেন তার কোনো কোম্পানি কমান্ডারের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। পরে একজন ট্যাংক ক্রু তাকে রেডিওতে বেশিরভাগ কমান্ডারের হতাহতের খবর দেয়। তিনি তাদেরকে এম্বুশ এরিয়া থেকে পিছু হটার নির্দেশ দেন। ক্যাপ্টেন মিনাসে গোল্ডব্ল্যাত নামের এক কোম্পানি কমান্ডার কাঁধে গুলি খেয়ে এবং আরপিজির আঘাতে মাথা ঠুকে আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তিনি ট্যাংকগুলোর ক্রুদের নির্দেশ দেন তারা যেন কোম্পানি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি থেকে ব্যাটালিয়ন ফ্রিকোয়েন্সিতে সুইচ করে। ফলে কমান্ডার জাকেন অবশিষ্ট ট্যাংকগুলোকে সরাসরি কমান্ড করার সুযোগ পান। ক্যাপ্টেন গোল্ডব্ল্যাত তার কাজকে সহজ করতে বিভিন্ন ট্যাংকের গানার, ড্রাইভার, লোডার ভারপ্রাপ্ত ট্যাংক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেন। লে.কর্নেল জাকেন বিভিন্ন ট্যাংককে তাদের ফায়ারিং সেক্টর ভাগ করে দেন যেন তারা পরস্পর পরস্পরকে কাভার দিতে পারে। এভাবে ট্যাংকগুলো আল-আর্বাইন স্কয়ারের মৃত্যুপুরী থেকে পিছু হটতে শুরু করে।
পাঠকদের ইসরাইলি বীর সেনানীদের একটি মজার গল্প না বলে থাকতে পারছিনা। একজন ট্যাংক কমান্ডার ছিলেন ঐ অক্ষত চার কমান্ডারের একজন। তিনি এতোটাই ভয় পেয়েছিলেন যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের দেয়া নির্দেশ মেনে পিছু হটতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার ঐ অফিসার ট্যাংক থেকে মাথা বের করতেই রাজি হননি। এসময় ক্যাপ্টেন গোল্ডব্ল্যাত তাকে এই বলে হুমকি দেন যে তিনি যদি অর্ডার মোতাবেক কাজ না করেন তবে তিনি নিজে পিছন থেকে গোলা মেরে তার ট্যাংকের পশ্চাৎদেশ উড়িয়ে দিবেন। এমন হুমকি পাওয়ার পর উক্ত কমান্ডার নির্দেশ মোতাবেক কাজ শুরু করেন। পরে তার কোর্ট মার্শাল হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।
সব মিলিয়ে ব্যাটল অফ সুয়েজে ইসরাইলিরা এত মার খেয়েছিল যে বলার বাইরে। আহতদের বিশেষ এপিসি (আর্মার্ড এম্বুলেন্সে) উঠানো হয়েছিল কিন্তু রাস্তাঘাট চেনা না থাকায় ঘুরপথে মেইন রাস্তায় যেতে পারছিল না। দয়াপরবশ হয়ে কয়েকজন মিশরীয় এসে তাদের এপিসি চালিয়ে মূল সড়কে উঠিয়ে দেয়! কিন্তু ইসরাইলিদের কপাল সেদিন আসলেই খারাপ ছিল। কোথা থেকে উড়ে আসা এক আরপিজি এপিসিতে আঘাত করে। এতে ভিতরের আহত যাত্রী সবাই মারা যায়। আহত ড্রাইভার কোনোরকমে বের হয়ে আবার শহরের ভিতরের ইসরাইলি সেনাদের অবস্থানের দিকে দৌড় দেয়। উক্ত আরপিজি মিলিশিয়া নাকি মিশরীয় সেনারা ফায়ার করেছিল তা নিয়ে মতভেদ আছে। সাধারণত আহত সেনাদের বহনকারী যানবাহনে হামলা করা যুদ্ধের নীতির বিরোধী (এই নিয়ম আর্মার্ড এম্বুলেন্সের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)। মৃত ও আহতদের বহন করা দ্বিতীয় আরেকটি এপিসিও হেভি ফায়ারিং মুখে চাকা নষ্ট হয়ে থেমে যায়। একে রক্ষা করতে এবার কর্নেল ইয়োফের নেতৃত্বে ইসরাইলি প্যারাট্রুপাররা এগিয়ে আসে। মিশরীয়রা এবার নতুন টার্গেটের দিকে নজর দেয়। মিলিশিয়াদের ছোড়া আরপিজি ইয়োফের এপিসিতে সরাসরি হিট করে। এতে তার চারজন সৈনিক মারা যায়, তিনি নিজেও মারাত্মক আহত হন।
কোনো রকমে বের হয়ে পাশের এক দালানে তিনিসহ তার সেনারা আশ্রয় নেয়। তবে লেফটেন্যান্ট ডেভিড আমিটের নেতৃত্বে দলের বেশিরভাগ সেনারা পাশের আল-আর্বাইন থানা ভবনের দিকে দৌড় দেয়। সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ে দুজন পুলিশ আহত ও আটজনকে গ্রেফতারের মাধ্যমে দোতলা ভবনটি দখল করে ইসরাইলিরা। দুঃসাহসী মিলিশিয়াদের ন্যায় মিশরীয় পুলিশরা আদৌ লড়াই করেছে এই ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। তা নাহলে এত সহজে পুলিশ স্টেশনের পতন ঘটতো না। এখানে আশেপাশের ভবন থেকে ৫০ জন ইসরাইলি প্যারাট্রুপার এসে জড়ো হয়। লেফটেন্যান্ট ডেভিড তাদেরকে নিয়ে পুরো থানা ঘিরে শক্তিশালী ডিফেন্সিভ পজিশন গড়ে তুলেন। ব্যাটালিয়ন ডাক্তার (মেজর) ও মেডিকেল কোরের সৈনিকদের জন্য একটি রুমকে এইড স্টেশন হিসেবে বরাদ্দ দেন যেন কর্নেল ইয়োফেসহ আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হয়। ফ্রন্টগেটের সামনে মেশিনগান পজিশন ছাড়াও প্রত্যেক জানালায় জানালায় সেনা মোতায়েন করেন। থানার পাশের ভবনের ছাদের উপর অবস্থান নেয় পাঁচ স্নাইপার ও মেশিনগানার। হাই গ্রাউন্ডের সুবিধা নিয়ে তারা আশেপাশের মিলিশিয়াদের থানার ধারেকাছেও ভিড়তে দিচ্ছিলো না।
থানার বাইরে থাকা পুলিশরা থানা পুনর্দখল করতে দুইবার চেষ্টা চালান। একবার দেয়াল টপকে ভবনের পাশ দিয়ে প্রায় ঢুকে পড়েছিল। তখনই এইড স্টেশনের মেজর ও তার সৈনিকরা হামলা করে তাদের শেষ করে দেন। দুইবারের হামলায় আরো আট জন পুলিশ নিহত হন। পায়ে গুরুতর আঘাত পাওয়া কর্নেল ইয়োফে চেতনা না হারানোর জন্য ব্যথানাশক মরফিন ইনজেকশন নিতে অস্বীকার করেন। এজন্যই হয়তো তার মাথা অন্যদের চেয়ে বেশি কাজ করছিল। তিনি আসন্ন আক্রমণের বিষয়টি টের পেয়ে দোতলা থেকে সবাইকে নেমে আসার নির্দেশ দেন। লেফটেন্যান্ট ডেভিড সেই নির্দেশ রেডিওতে সবাইকে কপি করে দেয়ার আগেই দোতলায় একাধিক আরপিজি ও গ্রেনেড হামলা হয়।
এতে আগুন ধরে যায় এবং হতাহতের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রচুর রক্তপাতের কর্নেল ইয়োফে তখন বারবার চেতনা হারাচ্ছেন। একবার জেগে উঠেই তিনি তিনি ম্যাপসহ তাদের সঙ্গে থাকা ক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট পুড়িয়ে ফেলতে নির্দেশ দেন। তার ধারণা ছিল থানার পতন এখন সময়ের ব্যাপার। মিশরীয় ইন্টিলিজেন্স এর হাতে যেন গোপন তথ্য না যায় সেজন্য এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাইরে থেকে তখন থানা ভবনের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি উড়ে আসছে। এসময় ইসরাইলিরা একজন বুড়ো পুলিশ অফিসারকে মুক্তি দেয়। তাকে জানায় যে তারা আত্মসমর্পণ করতে চায় এবং থানার ভিতরে থাকা গ্রেফতার পুলিশ সদস্যদের ক্ষতি করা হবে না। উক্ত অফিসার মিলিশিয়া ডেপুটি লিডার মোহাম্মদ শারহানের সাথে দেখা করেন। তিনি সেনাবাহিনীর কর্নেল ফতেহ আব্বাসের সাথে দেখা করিয়ে দেন। আব্বাস তাদের দুজনকে আত্মসমর্পণ এর শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করতে থানায় যেতে বলেন।
কিন্তু মিলিশিয়ারা ছিল একাধিক ভাগে বিভক্ত। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। শারহানের গ্রূপ যখন ফায়ারিং বন্ধ করে তখন অন্য কেউ না গোলাগুলি চালিয়েই যাচ্ছিলো। এজন্য শান্তিপূর্ণভাবে থানায় ঢোকা ছিল অসম্ভব। শারহান এবার পুলিশ অফিসারকে একা আবার থানায় যেতে চাপ দেন। তাকে অন্তত ইসরাইলিরা গুলি করবে না। কিন্তু নার্ভাস বুড়ো তখন ভয়ে কাঁপছে। ফলে কোনো নেগোসিয়েশন হয়নি এবং ইসরাইলিরা সারেন্ডার করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত আর করা হয়নি।
এরই মধ্যে এপিসি গ্রূপ থানায় আটকে পড়া ইসরাইলিদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের সাথে কোনো রেডিও যোগাযোগ ছিল না। ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সিগন্যাল দিতে এপিসির উপর ফার্নিচার নিক্ষেপ করে ইসরাইলিরা। কিন্তু ভয়ের চোটে হ্যাচ বন্ধ রাখায় এপিসি কমান্ডার আসলে বুঝতে পারেননি যে এটা মিশরীয় বেসামরিক মহিলাদের নয়, ইসরাইলিদেরই কাজ। তবে তাদের খুঁজতে গিয়ে আরেক ভবনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকভ হিসদাই এর নেতৃত্বে থাকা ৮০ জন প্যারাট্রুপারের একটি দলকে খুঁজে পায় এপিসি গ্রূপ। এদের বেশিরভাগই ছিল আহত। এদের মধ্যে ৬০ জনকে এপিসিতে করে উদ্ধার করা হয়। বেলা চারটার দিকে এই আক্রমণের অন্যতম নায়ক মিলিশিয়া লিডার ইব্রাহিম সোলায়মান থানা পুনর্দখলের উদ্যোগ নেন। তিনি তিন সঙ্গীকে নিয়ে বৈদ্যুতিক তারের খাম্বা বেয়ে থানায় ঢোকার চেষ্টা চালান। তবে কপাল খারাপ, ইসরাইলি স্নাইপারের চোখে ধরা পড়ায় তিনিসহ তার টিমের সবাই নিহত হন। তবে তার আরেকটি দল পাশের ভবনের ছাদে পাইপ বেয়ে নিঃশব্দে উঠে পড়ে। এখানে যে পাঁচ স্নাইপার-মেশিনগানার ছিল তাদের সাথে এদের ভয়াবহ লড়াই হয়।
দুই পক্ষের মাঝে হ্যান্ড টু হ্যান্ড ক্লোজ কোয়ার্টার কমব্যাটে উক্ত পাঁচ প্যারাট্রুপার নিহত হয়েছিল। এই লড়াইয়ে মিলিশিয়াদের হতাহতের খবর সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে এতে থানায় আটকে পড়া ইসরাইলিরা তাদের হাই গ্রাউন্ডের ওভারওয়াচ পজিশন হারিয়ে বেকায়দায় পড়ে। রাতের বেলা অন্ধকারের সুযোগে তারা বেড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে মিলিশিয়া কমান্ডার মাহমুদ আওয়াদ ইসরাইলিদের পরিত্যাগকৃত ১৫টি ট্যাংক ও এপিসিগুলোতে গ্যাসোলিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন যেন সেগুলো আর পুনর্দখল করতে না পারে।
ইসরাইলিদের পলায়ন:
জেনারেল আব্রাহাম আদানের তখন মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। তার বাহিনী যে এরকম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তা কল্পনাও করতে পারেননি। তিনি ইনফেন্ট্রি ইউনিটকে ফেলেই ট্যাংক ইউনিটকে পিছু হটার নির্দেশ দেন। কুইক রিয়েকশন ফোর্স হিসেবে তিনি অপর দুটো ব্যাটালিয়ন মুভ করান। এর একটি ট্যাংক গ্রূপ, অপরটি শহরের উত্তরে আটকে পড়া ইনফেন্ট্রি গ্রূপকে উদ্ধারে এগুতে থাকে। লে.কর্নেল জাকেন এর ব্যাটালিয়নে মোট ৮০ জন নিহত, ৩৫ জন আহত হয়েছিল। তার বহরের আরো তিনটি ট্যাংক অচল হয়ে যাওয়ায় তাদের পরিত্যাগ করে শহর ত্যাগ করেন তিনি। জেনারেল আদান প্যারাট্রুপারদের পায়ে হেঁটে পিছু হটার নির্দেশ দেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসদাই নতুন কৌশল করে ট্যাংক ব্যাটালিয়নের সাথে যুক্ত হন। তিনি ট্যাংকের প্রোজেক্টর বিম লাইট জ্বালানোর অনুরোধ করেছিলেন। সেটা দেখেই কর্নেল জাকেনের টিমের অবস্থান খুঁজে পান। কর্নেল ইয়োফের বাদবাকি সেনারা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসদাই এর খোঁজ না পেয়ে থানায় গিয়ে বাকিদের সাথে জড়ো হয়। থানায় তখন ইসরাইলি সৈনিকের সংখ্যা বেড়ে ৯০ জন হয় যার ২৩ জন গুরুতর আহত। ইয়োফে অজ্ঞান থাকায় লেফটেন্যান্ট ডেভিড আমিট তখন একমাত্র কমব্যাট কমান্ড অফিসার। তিনি পরিত্যাগ করা এপিসি থেকে পানি, ওষুধ, এমুনিয়েশন সংগ্রহ করার পর সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু কর্নেল কেরেন ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে থানা থেকে বেড়িয়ে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু ডেভিড চাচ্ছিলো সবাই একসাথে থাকতে যেন আবার হামলা হলে মোকাবেলা করা যায়। লে. কর্নেল হিসদাইও তাকে রেডিওতে বুঝানোর চেষ্টা করেন। এসময় জেনারেল স্যামুয়েল গোনেন তরুণ লেফটেন্যান্ট এর যুক্তি শুনে তার পক্ষ নেন এবং কেরেনকে নির্দেশ দেন সকালে থানায় আটকে পড়াদের উদ্ধার করা। কিন্তু চীফ অফ স্টাফের এই নির্দেশ তার মনঃপুত হলো না। কেননা দিনের আলোতে উদ্ধার অভিযান করতে গেলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরো বাড়বে।
জেনারেলের অর্ডার ওভাররাইড করার ক্ষমতা আছে ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল আব্রাহাম আদানের। তিনি র্যাংকে জেনারেল গোনেন এর জুনিয়র হলেও ব্যাটলফিল্ডে ট্যাক্টিক্যাল ডিসিশন নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। শেষপর্যন্ত লেফটেন্যান্ট ডেভিডকে পায়ে হেঁটে পিছু হটার নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি তার লোকজনকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। লেফটেন্যান্ট তার স্কোয়াডগুলোকে এমনভাবে ভাগ করেছিলেন যেন প্রত্যেক স্কোয়াড তিনজন করে আহত সেনা পরিবহণ করতে পারে। প্রত্যেক স্কোয়াড নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখেছিল কিন্তু তারা পরস্পরের দৃষ্টি সীমার মধ্যেই ছিল। রাস্তায় তখন মিশরীয় সেনায় গিজগিজ করছে। মিলিশিয়াদের সফল এম্বুশের খবর পেয়ে আশেপাশের এলাকার অনেক আত্মসমর্পণ করতে যাওয়া সেনা পুনরায় অস্ত্র তুলে নিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে আবার থানায় ফিরে আসেন ডেভিড। হতাশায় ইসরাইলি সেনাদের অবস্থা এমন হয়েছিল যে তারা কেউ কেউ আত্মহত্যার কথাও ভাবছিল। কেননা উদ্ধারের কোনো আশা নেই, সারেন্ডার এর কোনো সুযোগ নেই। আবার মিশরীয়রা যুদ্ধবন্দীও গ্রহণ করবে না, স্রেফ গুলি করে মারবে।
এতসব ঘটনা ঘটায় রেসকিউ অভিযান চার ঘণ্টা বিলম্ব হয়। এরই মাঝে ইসরাইলি রিকনসিস বিমান মিশরীয় পজিশনের এরিয়াল ফটো তুলতে সক্ষম হয়। এর সাহায্যে থানার আশেপাশে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু ইসরাইলি আর্টিলারি ব্যাটারি। এবার ডেভিড আগের মতো টিম নিয়ে একাধিক স্কোয়াডে ভাগ হয়ে বেড়িয়ে পড়েন। আর্টিলারি ফায়ারিংয়ে মিশরীয় ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় ইসরাইলিদের পালানোর কাজ সহজ হয়। তবে বেশ কয়েকবার ডেভিডের টিমের আশেপাশে দিয়ে মিশরীয় সেনারা হেঁটে গেছে। ইসরাইলিরা বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ফাঁকে, কানা গলিতে অবস্থান নিয়ে তাদের ফাঁকি দেন। ছোট ছোট স্কোয়াডে ভাগ হওয়ায় অন্ধকারে তারা ভেবেছিল এটি মিশরীয় কোনো সেনাদল। এভাবে ডেভিডের দল একটি রোড ব্রিজের কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু সেটি ছিল কঠোর মিশরীয় প্রহরা বেষ্টিত। এর একটু দূরেই আরেকটি রেল ব্রিজ পাওয়া যায় যা ইসরাইলিদের ম্যাপে উল্লেখ ছিল না। কর্নেল ইয়োফে ও লেফটেন্যান্ট ডেভিড বুঝতে পারেন তাদেরকে কতটা নিম্নমানের ব্যাটল ম্যাপ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে। রোড ব্রিজের বদলে রেল ব্রিজ পাড়ি দিয়ে ইসরাইলিরা শহরের বাইরে কর্নেল কেরেনের সাথে যুক্ত হন। তাদেরকে উদ্ধার করে জেনারেল আদানের কুইক রিয়েকশন ফোর্স।
সবমিলিয়ে এই যুদ্ধে ইসরাইলের ৮০ জন নিহত ও ১২০ জন আহত হয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল ৪০টি ট্যাংক/আর্মার্ড ভেহিকেল। মিশরীয় পক্ষে ক্ষয়ক্ষতির তেমন কোনো চিত্র জানা যায় না। তবে নিম্নমানের অস্ত্র ও ট্রেইনিং পাওয়া মিলিশিয়াদের কাছে তথাকথিত বিশ্বের অন্যতম সেরা ইসরাইলি বাহিনীর এমন মার খাওয়ার ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর। এটিই ছিল চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধের শেষ লড়াই। ব্যাটল অফ সুয়েজের পরপরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা চলে আসে। সুয়েজ সিটিতে মার খাওয়ার খবর শুনে অন্য একটি ইসরাইলি ইউনিট প্রতিশোধ নিতে ১০৯ টি মিশরীয় ট্রাক ও এম্বুলেন্স এর গতিরোধ করে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে তখন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সামগ্রিক যুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক ও কৌশলগত বিজয় ঘটে। নেতৃত্বের ভুলের কারণে ইয়াম কিপুর যুদ্ধে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত হেরে যায় মিশর। একই সঙ্গে ১৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাও হারায় তারা। পরবর্তীতে ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এসব এলাকা ফেরত দেয়া হয়, ইসরাইল-মিশরের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় এবং চিরস্থায়ী বিরোধের অবসান ঘটে।
(শেষ)
No Comments