হাসান ইবনে সাবাহ – ওল্ড মান অভ দি মাউন্টেইন
মধ্যযুগের ইসলামিক দুনিয়াকে শিয়াদের একটি ছোট্ট সম্প্রদায় প্রায় ১৩০ বছর ধরে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। তাদের নেতা ছিলেন হাসান ইবনে সাবাহ। তিনি একজন দুর্দান্ত সামরিক নেতা, সংগঠক এবং একনিষ্ঠ দায়ী (মিশনারী) ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক কাঠামোয়, তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল, সাহসী মানুষ।
প্রচলিত মান অনুসারে, ইসমাইলিরা তাদের অনেক শত্রুর যে কোন একটির সাথেও সামরিক শক্তিতে পেরে উঠত না। তবে একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ক্যারিশম্যাটিক এবং নির্মম হাসান-ই সাবাহ এই ছোট্ট, নিপীড়িত সম্প্রদায়টিকে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে মারাত্মক কার্যকর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত শাসকগণ — আব্বাসীয় ও ফাতিমিদ খলিফারা, মহান সেলজুক ও আইয়ুবিদ সাম্রাজ্যের সুলতান ও বীর সেনারা, ক্রুসেডার রাজ্যের রাজকুমারগণ এবং দামেস্ক, হোমস এবং মোসুলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর শাসনকারী আমিরগণ গিরগিটির মতো হত্যাকারীদের ভয়ে ভীত থাকত।
ফিদা’ই নামে পরিচিত (যিনি স্বেচ্ছায় নিজের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করেন, “কোরবানি” শব্দটির আরবি শব্দ থেকে; আরবি ভাষায় বহুবচনটি ফিদাইয়েন বা বর্তমানের ফেদায়েইন), এই জাতীয় এজেন্ট কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছর বিরোধী শিবিরে প্রবেশের জন্য ব্যয় করত তার শিকারের বুকে ছুরি বসানোর আগে। ইসামিলিদের বিনাশকারি যে কোন আমির হয়ত ঘুম থেকে জেগে দেখত তার বিছানার পাশে আমূলে বসানো একটি ছুরি, সাথে নোট যদি তিনি দাবি না মানেন তবে পরেরবার ছুরিটি ঢুকে যাবে তার বুকে। কখনো বা ছুরিটি সরাসরি শত্রুর বকে ঢুকে যেত। ইসমাইলিদের কাছে তিনি পবিত্র ধর্মীয় নেতা। অপরদিকে সুন্নি মুসলমানদের কাছে শয়তানের প্রতিভূ। কেননা সেলজুক সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার জন্য তার আসাসিন বাহিনীর একের পর এক আক্রমণ।
জন্ম ও বাল্যকালঃ
হাসান ইবনে সাবাহের জন্ম ১০৫০ সালে ইরানের কোম শহরে। পুরো নাম হাসান বিন আলী ইবনে মুহাম্মদ বিন জাফর বিন আল-হুসেন বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মাদ বিন-সাববাহ আল-হিমায়ারি। তার বাবা কুফা থেকে কোমে এসেছিলেন এবং শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
হাসানের ছেলেবেলায়ে তার পরিবার কোম থেকে রে তে চলে আসে। ছেলেবেলা থেকেই জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রতি হাসানের আগ্রহ তৈরি হয়। নবম শতাব্দী থেকে রে শহরে মৌলিক ইসলামি শিক্ষা প্রচলিত ছিল যার অন্যতম শিক্ষক ছিলেন কারমাত। এই ধর্মীয় কেন্দ্রে হাসান রূপক ব্যখ্যা বিষয়ে আগ্রহী হন। দিনের বেলা তিনি বাড়িতে পড়াশোনা করতেন এবং , ভাষা, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং গণিত (বিশেষত জ্যামিতি) বিষয়ে দক্ষ্যতা অর্জন করেন।
পটভূমিঃ
হযরত আলী (রাঃ)র কোন বংশধর পরবর্তী ইমাম হবেন সেই নিয়ে কোন্দলের ফলে শিয়ারা দুইতি ফিরকায় ভাগ হয়ে যায় অষ্টম শতকের মধ্যভাগে। শিয়াদের ইমাম জাফর মুহাম্মদ আস সাদিকের বড় ছেলে ইসমাইলের নাম অনুসিরারা ইসমাইলি নামে পরিচিত। তাদের মতে কোরানের বাহ্যিক (জাহির) এবং রূপক (বাতিন) দুই ধরনের অর্থ আছে। তাদের মতে একজন ইমামের আনুগত্য ছাড়া কোরানের সত্যিকার অর্থ কেউ জানতে পারে না। এ কারণে তাদের বাতিনিয়া এবং তালিমিয়াও বলা হত। ইসমাইলিরা পুরো মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করত। শিয়াদের মূল এবং সুন্নি মুসলমান উভয় দলই ইসমাইলিদের বিরোধী ছিল। একারণে ইসমাইলিরা গোপনে তাদের মিশন পরিচালনা করত। দা’ঈরা (ধর্ম প্রচারকারী) গোপনে ইসমাইলি শিক্ষা প্রচার করত।
৯১০ সালে ইসমাইলিরা তুনিসিয়ার শাসককে পরাভূত করে সেখানে ফাতিমিয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত করে। ৯৬৯ সালে ফাতিমি খলিফা মিশর জয় করেন ও কায়রোতে নিজেদের রাজধানী স্থাপন করেন। তারা বাগদাদ দখল করে আব্বাসীয় খেলাফতকে বরখাস্ত করে পুরো মুসলিম উম্মাহকে একীভূত করার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু মধ্য এশিয়া থেকে সেলজুক ও ইউরোপ থেকে ক্রুসেডারদের ক্রমাগত হামলায় ফাতিমিদ খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ে। ইরানের ইসমাইলিরা কায়রোর ফাতিমিদ খেলাফত পরিচালিত দাওয়া (“মিশন”) সমর্থন করত এবং ইমাম-খলিফা আল-মুস্তানসিরের শাসন মেনে চলত। তাদের হেডকোয়ারটার ছিল ইস্ফাহান।
হাসানের মিশর আগমনঃ
রে এর জিবাল ইসমাইলি মিশনারিদের কেন্দ্র ছিল। রে তে হাসান ২ জন প্রধান ইসমাইলি দাঈ আমির যারাব এবং আবু নাসে শিরাজ এর সংস্পর্শে আসেন। এখানে ১৭ বছর বয়সে হাসান বয়াত করে ইসমাইলি দীক্ষায়ে দীক্ষিত হন। তুরস্কের সেলজুকদের ইরাক ও ইরান দখল করে সুন্নি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
সেলজুক রাজদরবারের ইসমাইলিদের প্রধান দাঈ আব্দ আল মালিক ইবন আতাশের সাথে হাসানের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এবং ২৮ বছর বয়সে তিনি সেখানে দাঈ হিসেবে চাকরী পান। এভাবে তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ইস্ফাহানে ইসমাইলিদের গোপন কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ পান। এখান থেকে তিনি উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে কায়েরো এবং আলেক্সান্দ্রিয়া যান। ইমাম-খলিফা আল-মুস্তানসিরের পর খলিফা কে হবেন তাই নিয়ে কোন্দল শুরু হয়। আল মুস্তানসির বড় ছেলে ইমাম নিযারকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। কিন্তু খলিফা আল মুস্তান্সিরের ছোট ছেলেকে খলিফা বানাতে চাইছিলেন প্রধান মন্ত্রী আল আফদাল। হাসান ইবন সাবাহ, ইমাম নিযারের পক্ষে ছিলেন। তাই আল আফদালের সাথে তার মতবিরোধ শুরু হয়। ইসমাইলীরা এখন দুইটি আলাদা দলে ভাগ হয়ে গেল মুস্তাইলী এবং নিযারি। আল আফদাল তাকে বহিষ্কার করলে ১০৮১ সালে তিনি ইরান ফিরে আসেন। এখানে এসে তিনি নিযারী ইসমাইলী সমপ্রদায়ের অন্যতম দাঈ হন। এরপর তিনি সমগ্র ইরান ভ্রমণ করেন এবং নিযারী মতবাদ প্রচার করতে থাকেন, এসময় তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাবঃ
সেলজুক সুন্নিরা শিয়াদের সকল ফিরকার প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করত। এছাড়া সেলজুকেরা ১০৭০ সালের মধ্যে সিনাই উপত্যকা পর্যন্ত দখলে নিয়ে নেয়। এ সময় হাসান তাই অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি শক্ত ঘাটি খুঁজতে থাকেন। ১০৯০ এর সেপ্টেম্বরে তিনি আলামুত দুর্গ দখল করেন। রুদবার এলাকার আল বুরয পর্বতের মধ্যে, কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে এটি অবস্থিত। সমতল থেকে ৮০০ মিটার উঁচু দুর্গটি চুনাপাথর, গ্রানাইট, ও আগ্নেয় শিলার পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত। সাপের মত একেবেকে সরু সিড়ি উঠে গেছে চুড়ায়, এটিই দুর্গে পৌঁছানোর একমাত্র পথ। অল্প কয়েকজন সেনা এর হেফাজতের জন্য যথেষ্ট। হাসান আলামুত উপত্যকায় সেচ ও নিজস্ব কৃষি ব্যাবস্থার উন্নতি সাধন করেন। ফলে দুর্গটি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। অসংখ্য পান্ডুলিপি ও বৈজ্ঞানিক উপকরণ সহ বিশাল একটি লাইব্রেরি তৈরি করেন। পরবর্তী ৩৪ বছর হাসান এই আলামুত থেকে আর বাইরে যাননি।
যেহেতু ইসমাইলিরা সংখ্যায় খুব কম ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত। তাই তাদের জন্য বড় কোন সেনাবাহিনী গঠন করা সম্ভব ছিল না। হাসান এর জন্য বিশ্বস্ত দা’ঈ নিয়োগ করতেন। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হত হত্যা করার জন্য। একবার যে হাসানের মৃত্যুবার্তা পেত তার আর রেহাই ছিল না। তাকে নাগালে পেতে হাসানের ফিদা’ঈ অপেক্ষা করত মাস এমনকি বছরের পর বছর। কিন্তু তারা কখনো নিরীহ মানুষের উপর হামলা করত না। শুধুমাত্র যারা ইসমাইলিদের ক্ষতি বা ধ্বংস করার চেষ্টা করত তাদেরকে আসাসিনেরা টার্গেট করত। তাদের হত্যার পদ্ধতিও তাদের শত্রুদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল।
আসাসিনেরা অনেক সময় প্রকাশ্যে লোকজনের মাঝে তাদের টার্গেটকে হত্যা করত। দূর থেকে তীর মেরে হত্যা করার বদলে তারা একেবারে কাছে গিয়ে শিকারের বুকে ছুরি বসিয়ে দিত। যত কঠিন পাহারাই থাক না কেন আসাসিনদের হাত থেকে রেহাই ছিল না কারও।
১০৯১ সালে দাঈ হসেন কাইনিকে তিনি কুইস্তান বর্তমানের আফগানিস্তানে দাওয়াত প্রচারের জন্য পাঠান। তিনি এখানে সফলতা পান। স্থানীয় শিয়া আফগানদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এবং কয়েকটি শহর তাদের হাতে আসে। আলামুত দখলের কয়েক বছরের মধ্যে হাসান সেলজুক সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বাধীন নিযারী ইসমাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
১০৯২ সালে সেলজুক প্রতিনিধি নিযাম আল মুলক আলামুত ভ্যালি এবং আফগানিস্তানে আক্রমন করেন। কিন্তু হাসান সমর কৌশলে জিতে যান। তার ক্ষুদ্র সেনাদল পাহাড়চূড়ার নিরাপদ দুর্গ থেকে একের পর এক হামলা চালিয়ে শত্রুদের পরাস্ত করে। অবরোধ এর মধ্যেই হাসান তার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেন। এরপর থেকে আলামুত দুর্গে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এরই মাঝে কোনো এক সময় তিনি তার দুই ছেলেকে মদ্যপান ও হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়ত থাকার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেন।
এবার হাসান সেলজুক শিবিরে আঘাত হানেন। বু তাহির নামের একজন মাত্র দা’ঈ নিযাম আল মুলককে ছুরি মেরে হত্যা করে। বু তাহিরের এই সাফল্যের পর পরবর্তী ১০০ বছর সেলজুকদের উজির, আমির, খলিফা, সেনাপতি, ধর্মীয় নেতা এমনকি খ্রিষ্টান রাজাও হাসানের ফিদা’ঈদের ছুরির আঘাতে মারা যায়।
নিজামের হত্যার কিছুদিনের মধ্যে মালিক শাহের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। সেলজুক সাম্রাজ্যে গোলযোগ শুরু হল। তার দুই পুত্র বারকিয়ারুক এবং সাঞ্জার ও সৎ ভাই মুহাম্মাদ তাপার এর মধ্যে বিবাদের কারণে গৃহযুদ্ধ লাগে। সেলজুক সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন দ্রুত হয় আরও কিছু সেনাপতি স্বাধীনতা ঘোষণার পর।
এই সুযোগে হাসান তার রাজ্যের পরিধি বাড়াতে থাকেন। তিনি আলামুত দুর্গের ৫০০ কিমি পূর্বের দামগান দুর্গ দখল করেন। ১১০০ শতকের শুরুতে হাসান তার ফিদাইদের সিরিয়া পাঠানো শুরু করেন। এখানেও নিযারিরা পাহাড় চুড়ায়ে তাদের দুর্গ তৈরি করে। ৬টি দুর্গের মধ্যে সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য হল মাসিয়াফ। এখানেই আসাসিনদের সাথে টেম্পলারদের যোগাযোগ হয়। নাইটস অভ দি টেমপ্লাররা খৃষ্টান মিশনারি, অনেকটা আসাসিনদের মতই, তারা জেরুজালেমে তাদের পবিত্র ভূমি রক্ষা করত।
সেলজুক ও ক্রুসেডারদের মধ্যখানে আসাসিনেরা স্বেচ্ছা বা অনিচ্ছায় ভারসাম্যপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি মেনে চলে। ১১৫২ সালে তারা নাইট টেমপ্লারদের প্রোটেকশন মানি দেয়। কিন্তু ইসমাইলিদের কেউ আক্রান্ত হলে তারা বদলা নিতে ছাড়েনি।
সেই সময়ের আক্রা বর্তমানের ইস্রায়েলে ফ্রান্সের লুই নবম আসলে, আসাসিনেরা তার কাছে প্রোটেকশন মানি দাবি করে। যদি সম্রাট হাসানকে প্রটেকশন মানি দেন তাহলে তিনি বেঁচে যাবেন। দি গ্র্যান্ড মাস্টার জয়েণভীল অফ দি টেম্পলার হাসানের দূতকে খালী হাতে ফেরত পাঠান এবং সম্রাট ও হাসানের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি করে দেন।
ক্রুসেডাররা কনরাড অফ মন্তফেরাতকে আক্রায় তাদের নতুন রাজা হিসেবে ঘোষণা করে। ১১৯২ সালে কনরাড ২ জন ফিদা’ঈর হাতে নিহত হন।
আলেপ্পো নগরের একজন প্রিফেক্ট ১১১৩ সালে একটি আক্রমণ পরিচালনা করেন যাতে কয়েকশো ইসমাইলি মৃত্যুবরণ করে। এর ৬ বছর পর তিনি তার ২ ছেলে সহ ফিদা’ঈদের আম্বুশে মারা যান।
১০৯৭ সালে ঈমাম নিযার তার প্রতিপক্ষ আল আব্দালের হাতে নিহত হন। হাসান ফিদাই কায়রোতে পাঠিয়ে ইমাম নিযারীর ছেলেকে নিরাপদে আলামুত নিয়ে আসেন। এতদিন হাসান ইরানে নিযারিদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতা ছিলেন। কিন্তু, ইমাম না থাকায়ে এখন তিনিই হলেন সমগ্র নিযারি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা।
১০৯৯ সালে হাসান সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হানেন। তিনি ইস্ফাহানের কাছে শাহদিজ দুর্গ দখলের জন্য আহমেদ বিন আতাশকে পাঠান। আহমেদ ছিলেন হাসানের প্রথম শিক্ষকের ছেলে, যিনি ইসমাইলি বিশ্বাস গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আহমেদ দুর্গ দখলের জন্য অস্ত্রের পরিবর্তে ইমানের ব্যাবহার করেন। তিনি ক্রমান্বয়ে শিশু, এবং তারপর সৈন্যদের ইসমাইলি হিসেবে বয়াত করান। ১১০০ সাল নাগাদ আহমেদ ও নিযারিরা শাহদিজ দুর্গ দখল করে নেয়। এর ফলে নিযারিদের জন্য ইস্ফাহানের দরজা খুলে গেল।
কিন্তু ইতিমধ্যে যুদ্ধরত তিন সেলজুক ভাই বারকিয়ারুক এবং সাঞ্জার ও সৎ ভাই মুহাম্মাদ তাপার হাসানকে হারাতে সন্ধি করে। তারা সেলজুকদের একত্রিত করে দ্রুত আঘাত হানে ও ইস্ফাহানে তাদের দখল নিশ্চিত করে।
১১০৫ সালে তাপার সুলতান হলেন। এর ৪ বছর পর তিনি দ্বিতীয়বারের মত আলামুত অবরোধ করেন নিযারিদের আগ্রাসন চিরতরে নিরমূল করতে। এবার তার সেনাপতি আহমেদ আল মূলক, নিযাম আল মূলকের ছেলে। দীর্ঘ অবরোধের ফলে আলামুতে খাবারের প্রচণ্ড অভাব দেখা দেয়। কিন্তু এবারও ভাগ্য তাদের সহায়তা করে। সেলজুক বাহিনী যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন ১১১৮ সালে তাপার মারা যান, ফলে তার বাহিনী পিছে হটে যায়। নিযারিরা তখনো তাদের ছড়িয়ে থাকা দুর্গগুলো দখলে রেখেছিল। তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার জন্য দরকার ছিল এগুলকে একত্রিত করা। কিন্তু তার সেলজুকদের হাত থেকে ইরানকে মুক্ত করে সম্পুর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র তারা আর কখনো গড়তে পারেনি।
হাসান উপলব্ধি করেন যে তার ছোট্ট রাজ্য এভাবে ক্রমাগত যুদ্ধ করে কখনো টিকে থাকতে পারবে না। এরপর থেকে তিনি আগ্রাসনের নীতি থেকে সরে গিয়ে নিজের এলাকার নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করেন।
হাসানের মৃত্যুঃ
হাসান বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এখন তিনি বেশিরভাগ সময় আলামুতে নিজের বাসায় বই পড়তেন, বই লিখতেন এবং তার সম্প্রদায়ের মানুষদের সমস্যার সমাধান করতেন।
মনে করা হয় যে হাসান একটি আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। সরগোজ-এ সাইয়েদেনা (ফারসি: سرگذشت سیدنا) নামে একটি ইসমাইলি জীবনীগ্রন্থকে তার রচনার প্রথম অংশ বলে মনে করা হয়। হাসান ফারসি ভাষায় তালিমের মতবাদ অনুসারে একটি ও লিখেছিলেন, আল-ফুসুল আল-আরবা’আ, তার আর অস্তিত্ব নেই, তবে সেটির অনেক উদ্ধৃতি আল-শাহরাস্তানি এবং বিভিন্ন পার্সিয়ান ইতিহাসবিদরা বর্ণিণা করেছেন।
১১২৪ সালে ৭৪ বছর বয়সে তিনি বুঝতে পারেন যে তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। তিনি তার বিশ্বস্ত কিয়া বুজুর্গ উমিদকে আলামুতে তার খলিফা নিযুক্ত করেন। ১১২৪ সালের ১২ই জুন সামান্য অসুস্থতার পর মারা যান। ফিদাই আসাসিনেরা এরপর আরও ১০০ বছর পর্যন্ত সেলজুক ও অন্যান্য শত্রুদের বিপর্যস্ত করে রাখে।
১২৫৬ সালে মঙ্গলরা আলামুত দুর্গ শেষবারের মত অবরোধ করে দখল ও ধংস করে।
দারুন ঝরঝরে অনুবাদ। একটানে পড়ে ফেললাম। এইসব ইতিহাসের লেখাগুলো আরও চাই।