আদনান মেন্দেরসঃ তুরস্কের কিংবদন্তি প্রধানমন্ত্রী

ইস্তাম্বুলের দক্ষিণ উপকূল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে, বিখ্যাত বাইজেন্টাইন রাজপরিবারের বাসিন্দাদের পরিচিত প্রিন্সেস দ্বীপপুঞ্জের বাইরে, মারমারা সাগর থেকে কংক্রিটের দেয়ালের একটি গুচ্ছ উঠেছে। ইয়াসিয়াদা ছিল একসময়ে একটি অখ্যাত এবং অবহেলিত স্থান, যেখানে ছিল গুটিকয় ক্ষয়প্রাপ্ত, উঁচু হয়ে যাওয়া ভবন। কয়েক বছর আগে তুরস্কের কর্তৃপক্ষ একটি কনভেনশন সেন্টার, একটি মসজিদ, একটি হোটেল -এবং একটি জাদুঘরের জন্য জায়গা তৈরির জন্য বেশিরভাগ গাছ কেটে ফেলেছিল। দ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত বন্দী আদনান মেন্দেরেস (ছবিতে) এর স্মরণে দ্বীরটির নাম রাখা হয়েছে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দ্বীপ।

১৯৬০ সালের ২৭শে মে, তুরস্কের ইতিহাসে কালোতম দিন। এদিন আদনান  মেনদেরেস ও তার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। আদনান মেনদেরেস ছিলেন তুরস্কের গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রধানমন্ত্রী।  তিনি একদলীয় রাষ্ট্রের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন, দেশের বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন এবং কৃষকদের উন্নতির জন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি কঠোরভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মুসলমানদের সমান সুযোগ প্রদানের জন্য তাঁর পুরো আমলে কঠোর লড়াই করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, “তুর্কি জাতি মুসলিম এবং চিরকাল থাকবে। এই দেশে ধর্মের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা নিষিদ্ধ,”।

আদনান মেন্দেরিস

জন্ম এবং প্রথম জীবনঃ

আদনান মেনদেরেস এর জন্ম আইদিন প্রদেশের কোচারলিতে ক্রিমিয়ান তাতার পরিবারে ১৮৯৯ সালে। তিনি ইজমিরের আমেরিকান কলেজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি তার বেশিরভাগ জমিদারি ছোট শেয়ারহোল্ডারদের কাছে বিক্রি বা বিতরণ করেন, শুধুমাত্র একটি খামার নিজের জন্য রাখেন, যা আধুনিক কৃষি পদ্ধতির একটি মডেল হয়ে ওঠে।

১৯১৬ সালে তিনি মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০-১৯২৩ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে মেডেল অভ অনার লাভ করেন।

১৯৩০ সালে তিনি আইদিনে লিবারেল রিপাবলিকান পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন। দলটি বিলুপ্ত হওয়ার পর, কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পিপলস পার্টিতে যোগদানের জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানান। আরপিপি সে সময় তুরস্কের একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল ছিল। এটি পুরোপুরি পশ্চিমাপন্থী ছিল। এটি অতীতের অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভেঙে দিয়েছিল এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি চালু করেছিল।

পার্টির নেতারা তাকে ১৯৩১ সালে আইদিনের ডেপুটি হিসেবে নির্বাচিতি করেন।  এতিমধ্যে তিনি আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন স্কুল থেকে স্নাতক হন। ইস্মেত ইননুর জাতীয়তাবাদী নীতির বিরোধীতা করার জন্য দুইজন সহকর্মীর সাথে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন।

আদনান মেন্ডেরেসের সমাধি সৌধ

ঊত্থানপর্বঃ

১৯৪৫ সালের জুন মাসে, মেনদেরেস, জালাল বেয়ার, ফুয়াত ক্যাপ্রালি এবং রিফিক কোরালতান এই চারজন মিলে আরো বেশি রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা দাবি করেন। এই প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে ঐ চারজন ছাড়া আর কোনো সদস্য অনুমোদন করেননি এবং সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালের মধ্যে মেনদেরেস, ক্যাপ্রালি এবং কোরাল্টান এর আরপিপি দলের সদস্যপদ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় তুর্কি সরকারের বিরোধিতা করার অপরাধে। বায়ার তখন পার্লামেন্ট থেকে এবং পরে দল থেকেও পদত্যাগ করেন।

৭ই জানুয়ারী ১৯৪৬, ঐ চারজন ডেমোক্রেটিক পার্টি (ডিপি) গঠন করেন। এটিই তুরস্কের পরথম বিরোধী দল। ১৯৪৭ সালে মেনদেরেস ডেমোক্রেটিক পার্টির পাধান নির্বাচিত হন।

১৯৫০ সালের ১৪ই মে তুর্কির ইতিহাসে প্রথম অবাধ নির্বাচন হয় যেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টি ৫২% ভোট পেয়ে জিতে যায়। মেনদেরেস প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯৫৫ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও গ্রহণ করেন। পরে তিনি আরও দুটি অবাধ নির্বাচনে জয়লাভ করেন, একটি ১৯৫৪ সালে এবং অন্যটি ১৯৫৭ সালে। এভাবে তিনি ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীত্ব করেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাফল্যঃ

তিনি ১৯৫০ সালের নির্বাচনে আরবিতে আযান বৈধ করার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন, যা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আরবি প্রভাব থেকে তুরস্ককে ছাড়ানোর জন্য। ১৯ই জুন ১৯৫০ সালে, ১৮ বছর পর তুরস্কে আরবীতে আযান দেয়া শুরু হয়। তিনি তুর্কিদের হজ্বে যাবার অনুমতি দেন। পররাষ্ট্রনীতিতে পশ্চিমাপন্থী থাকা সত্ত্বেও তিনি মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করতেন। জনগণের গভীর ধর্মীয় উচ্ছ্বাসকে অনুভব করে, মেনদেরেস ইসলামিক ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি কামাল আতাতুর্ক এবং আরপিপির কঠোরতা অনেকটা শিথিল করেছিলেন।

তিনি সারা দেশে হাজার হাজার মসজিদ পুনরায় খুলে দিয়েছিলেন যা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং এইভাবে, তার রাজনৈতিক বিরোধীরা তাকে ধর্মকে রাজনৈতিক লাভের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার জন্য দায়ী করত।

৬১ বছর আগের একটি অভ্যুত্থান এখনও তুর্কি রাজনীতিতে ছায়া ফেলে

তার প্রথম রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলির মধ্যে একটি ছিল তুর্কি ব্যাঙ্কনোট এবং স্ট্যাম্পে স্মেট ইনোনুর ছবি বাদ দেওয়া এবং এর পরিবর্তে আতাতুর্কের ছবি ফিরিয়ে দেওয়া, যা ১৯৩৭ সালে ইনোনু রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময় তুলে নেওয়া হয়েছিল।

পশ্চিমাপন্থী হওয়া সত্তেও, তিনি মুসলিম দেশেগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরিতে তার পূর্বসূরীদের চেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন। মেন্ডেরেসের সময় পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীদের তুলনায় আরো উদার অর্থনৈতিক নীতি, এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কৃষির জন্য, বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য উচ্চ ব্যয় তাকে কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করেছিল। কিন্তু উদার অর্থনৈতিক প্রভাবে অপরিকল্পিত আমদানীর কারনে জাতীয় অর্থনীতি পিছিয়ে পড়ে।

তুরস্কের চরম অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও, মেনদেরেস কৃষকদের মাঝে তার জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিলেন। ১৯৫৪ ও ১৯৫৭ সালের নির্বাচনেঅ ডিপি উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়।

তার ১০ বছরের শাসনামলে তুরস্কের অর্থনীতি  ৯% বৃদ্ধি পায়। মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কৃষিতে যান্ত্রীকিকরন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, ব্যাঙ্কিং ও বীমা অগ্রগতি লাভ করে।

তিনি পূর্ব ও পশ্চিম উভয়ের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী করেন। এসময় তুরস্ক ন্যাটোতে সদস্যপদ লাভ করে।

ইস্তাম্বুল প্রোগ্রামঃ

সাইপ্রাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে চলমান লড়াই, এবং সাইপ্রিয়ট আন্তসম্প্রদায়িক সহিংসতা, ইস্তাম্বুল পোগ্রামের পটভূমির অংশ। যুক্তরাজ্য তুরস্ক ও গ্রীসকে লন্ডনে একটি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায়, যা ২৬শে আগস্ট, ১৯৫৫ সালে শুরু হয়। ত্রিপক্ষীয় লন্ডন সম্মেলন শুরু হওয়ার আগের দিন (২৯শে আগস্ট – ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৫৫)। মেনদেরেস দাবি করেন যে গ্রিক সাইপ্রিয়টরা তুর্কি সাইপ্রিয়টদের গণহত্যার পরিকল্পনা করছে। প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি ইডেন তুর্কি প্রতিনিধিদের পরামর্শ দেন যে তাদের কঠোর হওয়া উচিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতিন রুশ্তু জরলু ইডেনের কথাকে গুরুত্ব দিলেন এবং উদ্বোধনী বক্তৃতা শুরু করলেন এই বলে যে তুরস্ক লুসেন চুক্তির প্রতি তার প্রতিশ্রুতি পুনর্বিবেচনা করবে যদি গ্রীস সাইপ্রাসে তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা না করে। বক্তৃতার কঠোরতায় বিস্মিত গ্রীক প্রতিনিধিরা ব্রিটিশদের দোষারোপ করেছিল।

অবশেষে, সম্মেলনটি ৬ই সেপ্টেম্বর ভেঙ্গে যায়, সেদিন প্রথম সাইপ্রাসের বিষয়ে সম্মেলনে আলোচনা করা হবে, তখনই থেসালোনিকিতে বোমা হামলার খবর প্রকাশিত হয়।

সংখ্যালঘু গ্রিক জনগোষ্ঠী ইস্তাম্বুল শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর  থেসালোনিকিতে তুর্কি কনস্যুলেটের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয় যাতে আতাতুর্কের জন্মস্থান, ও আতাতুর্ক মিউজিয়াম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জানালার কিছু কাচ ভাঙা ছাড়া বাড়ির বড় কোন ক্ষতি হয়নি। প্রতিশোধ হিসেবে, ইস্তাম্বুলে গ্রীক সংখ্যালঘুদের হাজার হাজার দোকান, বাড়িঘর, গীর্জা এমনকি কবর কয়েক ঘন্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়, এক ডজনেরও বেশি মানুষ নিহত হয় এবং আরো অনেক আহত হয়। এই ঘটনা ইস্তাম্বুল প্রোগ্রাম নামে পরিচিত। মেনদেরেস সরকার ইস্তাম্বুল প্রোগ্রাম সংগঠিত করেছিল বলে মনে করা হয়।

সেনা অভ্যুত্থানের পর ১৯৬১ সালে ইয়াসসিয়াদা ট্রায়াল মেনদেরেস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফাতিন রুশ্তু জোরলুকে দাঙ্গার পরিকল্পনার জন্য অভিযুক্ত করে, তাতে দেখা যায় যে গ্রীকদের উপর হামলা আসলে মেনদেরেস সরকার দ্বারা পরিচালিত একটি উস্কানি ছিল, যারা থেসালোনিকিতে বোমা লাগিয়েছিল এবং বিক্ষোভ বাড়িয়ে তোলার জন্য আনাতোলিয়া থেকে লোক আনা হয়েছিল।

বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়াঃ

১৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯, তুর্কি এয়ারলাইন্সের বিমান ভিকার্স ভিসকাউন্ট টাইপ-৩, আদনান মেনদেরেস এবং সরকারি কর্মকর্তাদের একটি দলকে নিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে লন্ডন গ্যাটউইক বিমানবন্দরের একটি বিশেষ ফ্লাইটে রওনা হয়। ঘন কুয়াশার মাঝে প্লেনটি  রানওয়ে থেকে কয়েক মাইল দূরে সাসেক্স এর রাস্পারের কাছে বিধ্বস্ত হয় ও তাতে আগুন ধরে যায়। ষোলজন যাত্রীর মধ্যে নয়জন এবং আটজন ক্রুর মধ্যে পাঁচজন প্রাণ হারান। বিমানের পেছনের অংশে বসে থাকা মেনদেরেস দুর্ঘটনায় প্রায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান এবং দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে আসা স্থানীয় বাসিন্দা মার্গারেট বেইলির কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার ৯০ মিনিট পরে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন।

তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান এবং গ্রিক প্রধানমন্ত্রী কনস্টান্টাইন কারামানলিসের সাথে সাইপ্রাস ইস্যুতে লন্ডন চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পথে যাচ্ছিলেন। চুক্তিতে তিন পক্ষকে সাইপ্রাসে হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়া হয়েছে, যদি কোন পক্ষ শান্তি ভঙ্গ করে।

মেনদেরেস ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯ লন্ডন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে আসেন এবং এমনকি তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্মেত ইননু এবং বিপুল জনতা তাকে স্বাগত জানায়।

রাজনৈতিক শৈলী এবং বিশ্বাসঃ

ছোট শেয়ারহোল্ডারদের কাছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বেশিরভাগ এস্টেট বিক্রি বা বিতরণের জন্য মেনদেরেস বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা এবং ইসলামের বিভিন্ন রীতি অনুশীলনের প্রতি আতাতুর্ক এবং তার দলের চেয়ে বেশি সহনশীল ছিলেন।

১৯৫২ সালে তিনি ফ্রান্স ভ্রমণে গিয়ে প্যারিসে শেষ অটমান সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় এর স্ত্রী ও মেয়েকে কাপড় কাচার কাজ করতে দেখেন। তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট জালাল বায়ারের কাছে আপিল করেন সুলতানের পরিবারকে তুরস্কে ফেরার অনুমতি দেয়ার জন্য। তার আপিল মঞ্জুর হয়নি। এতে মেনদেরেস পদত্যাগ করলে সুলতানের পরিবারকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়।

তিনি প্রেস সেন্সরশিপ চালু করেছিলেন এবং সাংবাদিকদের গ্রেফতার করেছিলেন, পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিপীড়ন করার চেষ্টা করেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। একবার তিনি মিডিয়ার মিথ্যাচারের বিরোধীতায় বলেছিলেন, “আল্লাহ আমার শত্রুদের এমন বিরোধীতার থেকে রক্ষা করুন।”

“আমরা কি জাতি হিসেবে জানি না যে তারা কিভাবে প্রতিটি সফলতাকে বিপর্যয় এবং প্রতিটি সুন্দর এবং মহৎ কাজকে ক্ষতি হিসেবে দেখানোর জন্য বছরের পর বছর সংগ্রাম করে যাচ্ছে!” নির্বাচিত সরকারের বিরোধীতাকারীদের কাজের সমালোচনা করে তিনি বলেন।

মেনদেরেস যাকে সাধারণভাবে মানুষ পছন্দ করত এবং আর্মি চিফ অফ স্টাফ জেনারেল জামাল গার্সেলের সমর্থনও পেয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সামরিক বাহিনীর কট্টর তরুণ অফিসারদের মধ্যে তিনি ক্রমেই অপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন। তাদের শঙ্কা ছিল যে আতাতুর্কের আদর্শ বিপদে পড়েছে।

ক্ষমতা থেকে তার পতন নিয়ে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি সম্ভবত তদন্ত কমিশন (তাহকিকাত কমিসায়নু) প্রতিষ্ঠা। কমিশন, শুধুমাত্র ডেমোক্রেটিক পার্টির সাংসদদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল এবং সেই সাংসদদের রায় দেওয়ার অধিকার সহ নির্বাহী ও সামরিক প্রসিকিউটরের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। এটি ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতির পরিপন্থী এবং সংসদ সদস্যদের বিচারকাজ চালানো ও রায় দেয়া উভয় ক্ষমতা দিয়েছে। অধিকন্তু, কমিশনের রায় আপিল আদালতেও নেওয়া যাবে না।

ইয়াশিয়াদা (গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা) দ্বীপ

অভ্যুত্থান, বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডঃ

১৯৬০ সালের ২৭শে মে একটি সামরিক অভ্যুত্থান, ৩৭ জন “তরুণ অফিসার” দ্বারা সংগঠিত হয়। তারা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মেনদেরেস এবং বায়ার সহ দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘন, ইস্তাম্বুল প্রোগ্রামের আদেশ দেওয়ার এবং রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয়।

ইস্তাম্বুলের বাইরে প্রিন্সেস আইল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের একটি ছোট দ্বীপ মেনদেরেসর একটি কারাগারে তার বিচার করা হয়েছিল। পক্ষপাতদুষ্ট ও অবৈধ সামরিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যদণ্ডের রায় দেয়।

১৯৬১ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মারমারা সাগরে ইমরালি দ্বীপে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। তার সঙ্গে আরও দুই মন্ত্রী ফাতিন রুস্তু জোরলু, পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং হাসান পোলাটকান, অর্থমন্ত্রীতাদেরও ফাঁসী দেয়া হয়।

হেড অফ স্টেট জামাল গার্সেল এবং এমনকি ইস্মেত ইনোনু, জন এফ কেনেডি এবং রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় সহ বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতার ক্ষমার জন্য আবেদন সত্ত্বেও, মেনদেরেসকে ফাঁসী দেয়া হয় । প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জামাল বায়ারকে বয়সের কারণে ফাঁসীর বদলে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

সামরিক জান্তা যখন তার সামনে ফাঁসির আদেশটি পড়েছিল, তিনি শুধু বলেছিলেন “আল্লাহ আমাদের জাতিকে রক্ষা করুন।”

শুধুমাত্র একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করার জন্য জান্তা তার মৃত্যুদণ্ডের কয়েক ঘণ্টা আগে মেন্ডেরেসের প্রোস্টেট পরীক্ষার নির্দেশ দেন। তারপর তারা তাকে তার শেষ কথাগুলো বলতে বলল।

তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে যখন আমি জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছি, আমার পরিবার এবং সন্তানদের বল যে আমি তাদের সমবেদনার সাথে স্মরণ করি। আল্লাহ আমাদের মাতৃভূমি এবং জাতিকে চির কল্যাণ দান করুন।”

দুই মাস পরে, ইসমেত ইনোনু সামরিক নেতৃত্বের অধীনে, জোট এবং নতুন উদীয়মান জাস্টিস পার্টির (তুর্কি ভাষায়: আদালেট পার্টিসি) সহায়তায় একটি নতুন সরকার গঠন করেন। মেন্ডেরেসের উত্তরাধিকারী আদালেট পার্টিসি পরবর্তী নির্বাচনে বিশেষ করে সুলেমান ডেমিরেলের নেতৃত্বে জয়লাভ করে।

জাতির ক্ষমাঃ

১৯৯০ সালে, তার মৃত্যুর ২৯ বছর পর, তুর্কি পার্লামেন্ট আদনান মেনদেরেস ও তার সঙ্গীদেরকে সবধরনের অসদাচরণ এর দায় থেকে মুক্তি দেয় এবং তাকে মরণোত্তর ক্ষমা দেয়া হয়। আজ, ইস্তাম্বুলে তুরগুত ওজালের সমাধির পাশে তার সমাধি অবস্থিত। এছাড়াও, আয়দিন প্রদেশের আদনান মেনদেরেস বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইজমিরের আদনান মেনদেরেস বিমানবন্দর তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।

তুরস্ক জুড়ে ছোট -বড় শহরগুলোতে সিটি কাউন্সিল কর্তৃক অসংখ্য নগর জেলা, বুলেভার্ড এবং রাস্তার নাম রয়েছে তার নামে।

ইয়াসিয়াডা, ইস্তাম্বুলের দক্ষিণ -পূর্বে মারমারা সাগরে অবস্থিত প্রিন্সেস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ, যেখানে তিনি বন্দী ছিলেন। ২০১৩ সালে এর নামকরণ করা হয় গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দ্বীপ।

গত বছর প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান মেনদেরেসয় গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দ্বীপের উদ্বোধন করন।

One Comment

Add a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।