বসনিয়া যুদ্ধ : বৃহত্তম মুসলিম গণহত্যা পরবর্তী গণকবর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার (পর্ব-২)

গণকবর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার  :

যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই একাধিক গণকবর আবিষ্কৃত হয়। আদমশুমারি ও নিখোঁজ লোকদের তালিকা মিলিয়ে প্রাথমিক পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। গণকবরের হতভাগ্যদের শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। জীবিতদের থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে লাশ থেকে প্রাপ্ত নমুনা মিলিয়ে স্বজনদের কাছে দেহাবশেষ ফিরিয়ে দেয়া হয়। স্রেব্রেনিৎসাসহ গণহত্যা হয়েছে এমন এলাকাগুলোতে আলাদা কবরস্থানে তাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পুনরায় সমাধিস্থ করা হয়।

ছবিঃ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গণকবর থেকে হতভাগ্যদের লাশ উত্তোলন করা হচ্ছে।
ছবিঃ ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড স্টাডি স্কলারদের একটি প্রতিনিধিদল গণকবর পরিদর্শন করছে।
ছবিঃ হতভাগ্যদের কফিনে তাদের দেশের অংশবিশেষ ছিল। পুরো দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

বসনিয়ার গণহত্যার সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যতটা নিষ্ক্রিয় ছিল, যুদ্ধের পর গণহত্যাকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনতে তারা ঠিক ততটাই সক্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৯৩ সালের মে মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর যুগোশ্লাভিয়া (ICTY) নামক আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সৃষ্টি করে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৪৫-৪৬ সালে গঠিত নুরেমবার্গ আদালতের পরে গঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক আদালত। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার দায়ে রাদোভান কারাদজিচ ও বসনীয় সার্ব জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ প্রধান আসামি করে মোট ১৪১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মেলোসেভিচকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, ও যুদ্ধাপরাধের পরোক্ষ নেতৃত্বের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। নিয়তির পরিহাস এমনই যে ২০০০ সালের নির্বাচনের ফল বর্জন করে ক্ষমতায় থাকায় চেষ্টা করায় খোদ সার্বিয়ানরাই আন্দোলন করে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ডিপ্রেশনে পরে নিজে স্ত্রীকে হত্যা চেষ্টা করে গ্রেফতার হন। ২০০২ সালে আদালতে হাজির করা হয়। তার পক্ষে কেউ আইনজীবী হতে চায়নি বিধায় নিজেই নিজের ডিফেন্স ল-ইয়ারের ভূমিকা পালন করেন। তার রুগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে বিচার বিলম্বিত হতে থাকে। ২০০৬ সালে তাকে তার কারাকক্ষে মৃত পাওয়া যায়। তার হার্ট এট্যাকে মৃত্যু হয়েছিল।

ছবিঃ আদালতে স্লোবোদান মিলোসেভিচ

দুই বলকান কসাইঃ

মিলোসেভিচকে গ্রেফতার করা গেলেও বাকি দুজন বলকান কসাই তখন পলাতক। সিআইএ, ইন্টারপোল সহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর Most Wanted লিস্টের শুরুতেই তাদের নাম চলে আসে। তৎকালীন সময়ে তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৩ বছর ধরে পলাতক থাকার পর ধরা পড়েন রাদোভান কারাদজিচ। সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডের ডাক্তারের ছদ্মবেশে বসবাস করছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুটি গণহত্যা, পাঁচটি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড, চারটি যুদ্ধাপরাধ এবং একটি জেনেভা চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়। কারাদজিচ নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।  তার যুক্তি ছিল যে তিনি একজন রাজনীতিবিদ, যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের দায় তো সংশ্লিষ্ট মিলিটারি কমান্ডারদের উপর বর্তায়। বিচার শেষে তাকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড হয়। (ইউরোপের অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই)।

ছবিঃ ডাক্তারের ছদ্মবেশ ধরেও গ্রেফতার এড়াতে পারেননি রাদোভান কারাদজিচ

 

অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদেরও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়। এদের মধ্যে ২০ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত স্লোবোদান প্ৰালজাকের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। তিনি আদালতের মধ্যেই সায়ানাইড পিল খেয়ে সুইসাইড করেন। ঘটনাটি ভিডিওতে দেখুন।

কারাদজিচের বিচার চলাকালেই ধরা পড়েন অপর পলাতক আসামি জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ। তিনিও উত্তর সার্বিয়ার একটি গ্রামে ছদ্মনাম পরিচয় ব্যবহার করে লুকিয়ে ছিলেন।  তিনি আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে ‘বানোয়াট’বলে দাবি করেন। তাতে কাজ হচ্ছেনা দেখে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত বিচারকার্য বিলম্বিত করেন। প্রায় ৬০০ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও বিভিন্ন প্রমাণের ভিত্তিতে চার বছর ধরে বিচারকাজ চালানোর পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত সাবেক এই জেনারেলকে কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলেও সাজা বহাল থাকার রায় ২০২১ সালের ৮ জুন প্রদান করে। তবে ৭৮ বছর বয়সী জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ কতদিনই বা তার ভয়াবহ পাপের শাস্তি পাবেন সেটি বলাই বাহুল্য।

ছবিঃ আদালতের কাঠগড়ায় রাতকো ম্লাদিচ
ছবিঃ নিহতদের সমাধিফলক। এখানে সাড়ে ছয় হাজার হতভাগ্যকে পুনঃদাফন করা হয়েছে।
ছবিঃ গণহত্যায় নিহতদের নামফলক
ছবিঃ নিহতদের স্মরণে জড়ো হয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনগণ।

বসনিয়া যুদ্ধেই আধুনিক যুগের সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি রোধ করতেই কয়েক বছর পরে হওয়া কসোভো যুদ্ধে জাতিসংঘ ও ন্যাটো দ্রুত হস্তক্ষেপ করেছিল। বসনিয়ার মতো আর কোনো যুদ্ধেই যেন এরকম ভয়াবহ গণহত্যা না হোক, শান্তিপ্রিয় মানুষের এটাই কামনা।

Add a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।