বেঙ্গল সালতানাত : শাহী বাংলায় সুদীর্ঘ সুলতানী শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : দ্বিতীয় পর্ব

হোসেন শাহী রাজবংশঃ

ইলিয়াস শাহী বংশের পর হোসেন শাহী বংশ দীর্ঘ সময় বাংলা শাসনকারী দ্বিতীয় রাজবংশ ছিল। সৈয়দ হোসেন হাবশি শাসনামলে আরব অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে এদেশে এসে নিজ যোগ্যতায় উজির হিসেবে চাকরি পান। কিন্তু মুজাফফর শাহ স্থানীয়দের উপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু করলে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা কেড়ে নেন।

১। আলাউদ্দিন হোসেন শাহঃ উজির থেকে রাতারাতি সুলতান বনে যাওয়া এই ব্যক্তি সিংহাসনে বসেই তিনি সকল হাবশি আমির ও সৈন্যদের বাংলা থেকে বিতারিত করে তাদের জায়গায় স্থানীয় আমিরদের প্রাধান্য দেন। আফগান ও মঙ্গোল সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা আমিরগণ তার কাছে প্রাধান্য পায়। তিনি ১২ হাজার লুণ্ঠনকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে বাংলার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। জৈনপুরের বিতারিত সুলতান হোসেন শাহ শার্কিকে আশ্রয় দিলে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদির সাথে তার যুদ্ধ ও পরে সন্ধি হয়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের পর এটিই বাংলা-দিল্লির পুনঃসংঘর্ষ।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর আমলে বাংলার সীমানা সর্বোচ্চ মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তিনি কামরূপ-কামতা, আসামের অহোম, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা ও আরাকান দখল করে নেন। তার আমলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল সর্বোচ্চ। নিজের উজির, ব্যক্তিগত চিকিৎসক, টাকশালের প্রধান, সেনাপতি এমনকি দেহরক্ষী হিসেবে হিসেবেও হিন্দুদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। উদারতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন হিন্দু কবি-সাহিত্যিকগণ হোসেন শাহকে ‘নৃপতি তিলক’, ‘জগৎভূষণ’, ‘কৃষ্ণবতার’ প্রভৃতি উপাধি দিয়েছিলেন। তার আমলেই শ্রী চৈতন্যদেব বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ঘটান। গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ, মানিকগঞ্জের নাচাইল মসজিদ, গোমতি ফটক তার যুগের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।

২। নাসিরউদ্দিন আবুল মুজাফফর নসরত শাহঃ

১৫১৯ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে নসরত শাহ সিংহাসনে বসেন। এরপর তিনি পিতার অসমাপ্ত ত্রিহুত ও বিহার জয় করেন। এসময় ত্রিপুরার রাজা দেব মানিক্য চট্টগ্রাম দখল করে নেন। আবার পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত মাহমুদ লোদি (সিকান্দার লোদির ভাই) বাংলায় আশ্রয় নিলে মুঘল সম্রাট বাবর বাংলা আক্রমণ করেন। ১৫২৯ সালে গোগ্রার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও নুসরত শাহের কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে মুঘলরা বাংলার দিকে আর নজর দেয়নি। তার সময়ে পর্তুগিজ বনিকরা ব্যবসার জন্য বাংলায় এসে দুর্গ নির্মাণ চেষ্টা করলে তিনি চট্টগ্রাম পুনঃদখল করে সেই চেষ্টা নস্যাৎ করে দেন। নুসরত শাহ রাজ্যের পানির কষ্ট দূর করতে বহু কূপ ও হ্রদ খননের জন্য বিখ্যাত। বাগেরহাটের মিঠাপুকুর তার আমলের নিদর্শন।

৪। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহঃ

১৫৩২ সালে এক প্রাসাদরক্ষীর হাতে নুসরত শাহ নিহত হবার পর তার ছেলে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ক্ষমতায় বসেন। তবে এক বছরের মাথায় চাচা গিয়াসউদ্দিনের হাতে নিহত হন। তিনি ছিলেন হোসেন শাহী বংশের সবচেয়ে অযোগ্য শাসক। ১৫৩৪ সালে সুরুজগড় এবং ১৫৩৮ সালে গৌড়ের যুদ্ধে তরুণ আফগান সেনাপতি শেরখানের পরাজিত হয়ে মাহমুদ শাহ বিতারিত হলে হোসেন শাহী বংশের পতন ঘটে।

ছবিঃ সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর আমলে নির্মিত গোমতি গেট।

এরই মধ্য দিয়ে শাহী বাংলার চূড়ান্ত পতন ঘটে। কেননা শেরখান বাংলা দখল করেছে শুনে তাকে দমন করতে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন এগিয়ে এসে রাজধানী গৌড় দখল করেন। বাংলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হুমায়ন ৬ মাস আনন্দ ফুর্তিতে কাঁটিয়ে দেন। এদিকে শের খান শক্তি সঞ্চয় করে অপেক্ষায় থাকেন। দিল্লির সিংহাসন সৎভাই হিন্দালের দখলের চেষ্টা শুনে যখন হুমায়ুন দিল্লি রওনা দেন তখনই তাকে আক্রমণ করে বক্সারের যুদ্ধে তাকে পরাজিত করে বাংলা ও দিল্লি – দুটোই দখল করে নেন শের শাহ! ফলে বাংলা আবার দিল্লির অধীনে চলে যায়। পরে শেরখানের উত্তরাধিকারদের মধ্যে লড়াইয়ের সুযোগে হুমায়ুন দিল্লি পুনরুদ্ধার করলেও বাংলায় নজর দিতে পারেননি। সেখানকার সিংহাসন নিয়েও শেরখানের উত্তরসুরী শুর বংশ (১৫৩৮-৬৪) এর উত্তরাধিকারদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। সুযোগ পেয়ে তাদেরকে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেন শেরখানের আফগান কর্মচারী তাজ খান কররাণী। তার কররাণী বংশ ১৫৬৪-৭৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। অবশেষে সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররাণীর পরাজয়ে বাংলা দিল্লির প্রদেশ হয়। কিন্তু ঝামেলা শুরু করে বার ভুঁইয়া নামে পরিচিত কয়েকজন ঐক্যবদ্ধ প্রভাবশালী জমিদার। প্রায় ৩০ বছর পর মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে তাদেরকে সম্পূর্ণ দমনের মাধ্যমে বাংলা পুনরায় মুঘলদের শাসনে চলে যায়। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশদের শাসনে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দিল্লির অনুগত মুঘল সুবেদাররা বাংলা প্রদেশ শাসন করেছে। শেষদিকে বাংলার নবাবেরা স্বাধীনভাবে শাসন করলেও দিল্লির প্রতি আনুগত্য বা বিদ্রোহ কোনোটাই করেনি। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো ভারতবর্ষের ক্ষমতা কৌশলে দখল করে প্রায় দুইশো বছর শাসন করে।

সংক্ষেপে এই ছিল মধ্যযুগের বাংলা অঞ্চলে সুলতানি শাসনামলের ঘটনা প্রবাহ। চলুন দেখে নেয়া যাক এসব যুগের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আরো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাথে।

ছবিঃ নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ।
ছবিঃ ‘বাদশাহি তখত’ নামে পরিচিত কুসুম্বা মসজিদের এই মেহরাবের ন্যায় সুলতানের জন্য নির্মিত বিশেষ সিংহাসন থাকতো যা রাজকীয় আদালতের কাজের সময় ব্যবহার হতো।
ছবিঃ বাগেরহাঁটের ষাট গম্বুজ মসজিদ ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত।
ছবিঃ সুলতান জালালউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর আমলের মুদ্রা।
ছবিঃ গৌড়ের দাখিল দরজা
ছবিঃ শহরের সীমানা নির্দেশক বাইশ গাজী দেয়াল।
ছবিঃ হাবশি সুলতান সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ এর আমলে নির্মিত ফিরোজ মিনার।
ছবিঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারসবাড়ি মসজিদে একাধিক মেহরাব ছিল।
ছবিঃ ভারতের কুতুব শাহী মসজিদ।

 

বেঙ্গল সালতানাত : শাহী বাংলায় সুদীর্ঘ সুলতানী শাসনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : প্রথম পর্ব

No Comments

Add a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।