মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীঃ জীবনী ও কর্ম

বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণ আন্দোলনের নায়ক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানী ছিলেন একটি স্ব-শিক্ষিত মানুষ। মওলানা ভাসানীকে বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে তার ভক্তরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, অসাম্প্রদায়িক এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁকে রেড মাওলানা নামেও ডাকা হয়।

জন্ম ও বাল্যকালঃ

জন্ম ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম হাজী শরাফত আলী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ছোট ৪টি সন্তান রেখে তাঁর বাব অল্প বয়সেই মারা যান। কিছুদিন পর মহামারিতে হামিদের মা ও দুই ভাইও মারা যায়। এতীম হামিদ চাচা ইব্রাহিম এর দায়িত্বে লালিত পালিত হতে থাকেন। সম্ভবত ১৮৮৭ সালে ভাসানী মরহুম মাওলানা আব্দুল বারী চিশতীর সিরাজগঞ্জের মাদ্রাসায় ছাত্র হন।

এই সময়ে ইরাক থেকে সিরাজগঞ্জে আসেন নাসির উদ্দীন বোগদাদী নামে একজন ধর্মপ্রচারক। হামিদ তাঁর তত্ত্বাবধানে কিছুদিন কাটান। ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ান।

রাজনীতিতে আগমনঃ

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে হামিদ পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম গমন করেন। সেখানে তিনি ১৯০৩ সালের আন্দোলনে যোগ দেন। উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা অর্জনের জন্য ১৯০৭ সালে ভারতের দেওবন্দ যান। মাহমুদুল হাসান (শাইখুল হিন্দ) এবং অন্যান্য বিখ্যাত প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদদের দ্বারা তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সচেতন হয়েছিলেন। দুই বছর পর আসামে ফিরে আসেন। ১৯০৯  সালে তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।

মহামন্দার সময় তিনি নির্যাতিত কৃষকদের নেতৃত্ব নিতে টাঙ্গাইলের সন্তোষে যান। টাঙ্গাইল থেকে তিনি ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকে আসামের কাগমারায় চলে আসেন এবং সেখানে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের স্বার্থ রক্ষা করেন।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহে ভাষণ দান করেন। হামিদ তাঁর এ ভাষণ শুনে ভীষণ অণুপ্রাণিত হন। চিত্তরঞ্জন দাস এবং মোহাম্মদ আলী জওহর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভাসানী ১৯১৭ সালে রাজনীতিতে সক্রিয় হন, অবশেষে ১৯১৯ সালে কংগ্রেস পার্টিতে যোগদান করেন।

১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন।

বিবাহ ও আসাম গমনঃ

১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন। আসাম সরকার সেসময় একটি আইন প্রণয়ন করে যার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক রেখার মধ্যে বাঙ্গালীরা বসতি স্থাপন করতে পারবে না। এতে আসামে বাঙালীদের স্বার্থ মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভাসানী এই লাইন প্রথার বিরুদ্ধে “আসাম চাষী মজুর সমিতি” গঠন করেন এবং ধুবড়ি, গোয়ালপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ করেন।

ভাসান চরের কৃষক আন্দোলনঃ

আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান ভাসানী। তিনি ব্রহ্মপুত্রের ভাসান চরে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের সহযোগিতায় একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন, যার ফলে কৃষকদের বার্ষিক জলাবদ্ধতার ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছিলেন। বন্যার কবল থেকে রেহাই পেয়ে স্থানীয় জনগণ তাকে আদর করে ভাসানী সাহেব বলে ডাকতে শুরু করে। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।

১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন এর আয়োজন করেন তিনি। ত্রিশ এর দশকে মহামন্দার সময়ে নিপীড়িত কৃষকদের পক্ষে তিনি নেতা হিসেবে পাশে দাঁড়ান।

১৯৩১ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে, সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায়, ১৯৩৩ সালে গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন।

 

মুসলিম লীগে যোগদানঃ

১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং দলের আসাম ইউনিটের সভাপতি হন। ‘লাইন’ ইস্যুতে, মৌলানা এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মুহাম্মদ সা’দুল্লাহর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে “বাঙ্গাল খেদাও” আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান।

অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি ১৯২০ সালে গ্রেপ্তার হন এবং দশ মাসের জন্য কারারুদ্ধ হন। মুক্তির পর, তিনি খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন।

তিনি ১৯৪৭ সালের সিলেট গণভোটের সময় আসামের মুসলমানদের মাঝে প্রচারণায় নেতৃত্ব দেন, যার মাধ্যমে সিলেট পাকিস্তান এর অংশ হবার মত বেছে নেয়। একই বছর আসাম সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে  পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে । দেশভাগের সময় মওলানা ভাসানী আসাম এর গোয়ালপাড়া জেলায় লাইন প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করছিলেন। আসাম সরকার ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে আসাম ছেড়ে যাওয়ার শর্তে মুক্তি দেয়।

১৯৪৮-এ তিনি মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন।

১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

ভাসানী একটি উপ-নির্বাচনে দক্ষিণ টাঙ্গাইল থেকে প্রাদেশিক আইনসভার একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ী হন, মুসলিম লীগ প্রার্থী এবং করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করেন।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা  করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ আমলে বাংলা প্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপরও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন।

আময়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাঃ

১৯৪৯-এ, তিনি আসামে ফিরে আসেন এবং ধুবড়িতে বন্দী হন । মুক্তি পেয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যাভাব দেখা দেয়।

২৩ ও ২৪ শে জুন, ১৯৪৯, মুসলিম লীগের অসন্তুষ্ট সদস্যরা ঢাকায় একটি কর্মী সম্মেলন আহ্বান করে। সম্মেলনে সমগ্র প্রদেশ থেকে প্রায় ৩০০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মাওলানা ভাসানী এবং সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে সভার প্রথম দিন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক এবং যৌথভাবে যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক । ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবী করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হন।

১৯৫০ রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দিদের উপর গুলি চালানো হয়। এর প্রতিবাদে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন করেন। ১০ ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।

এই সময়ে বাংলার রাজনীতিতে ভাসানী সবচেয়ে সম্মানিত রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন।

৩০ জানুয়ারী, ১৯৫২ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম জাতীয় ভাষা করার লক্ষ্যে ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরি হলে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। ভাসানী সরকারের বর্বরতার তীব্র নিন্দা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে তার গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। জমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

ধারণা করা হয় যে, বারাবার জেলে অবস্থান করার কারণে কমিউনিস্টদের সাথে ঘন ঘন যোগাযোগ মওলানাকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলেছিল। যার সাথে তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনধারা বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তিনি আদমজী জুট মিল মজদুর ইউনিয়ন এবং পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের সভাপতি হন।

১৯৫৪ সালের মে দিবসে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে কমিউনিস্টদের দ্বারা আয়োজিত দুটি বিশাল শ্রমিক সমাবেশে মাওলানাকে সভাপতি করা হয়। একই বছর তাকে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সভাপতি করা হয়। এর পরপরই তাকে কমিউনিস্ট অধ্যুষিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান এর পক্ষ থেকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়।

যুক্তফ্রন্ট গঠনে নেতৃত্বঃ

প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ভাসানী যুক্তফ্রন্ট নামে একটি জোট গঠন করে পাঁচটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৪ ডিসেম্বর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও এ. কে. ফযলুল হক যুক্তফ্রন্টের পক্ষে যৌথ বিবৃতি দেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পরিদর্শন করেন, বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে এখানে তিনি সরাসরি জ্ঞান অর্জন করেন।

৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন জারি করে। ফজলুল হককে গৃহবন্দী ও শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। নব নিযুক্ত গভর্ণর বিবৃতি দেন যে “ভাসানী দেশে ফেরামাত্র তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে”।

১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৫৬তে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হলে, মওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেন৷

এদিকে ক্ষমতা ভাগাভাগি প্রশ্নে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। মাওলানা বাস্তবিক রাজনীতির সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে এবং আতাউর রহমান খানকে পূর্ব বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী করে কেন্দ্রে আওয়ামী কোয়ালিশন সরকার গঠন করলে তিনি হতাশ হন।

পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন।

কাগমারী সম্মেলনঃ

৮-১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৭ সালে, মাওলানা কাগমারীতে পার্টির পক্ষ থেকে একট সাংস্কৃতিক সম্মেলন এর আয়োজন করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অণুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সম্মেলনে ভারত থেকেও প্রতিনিধিরা যোগ দেন। ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনও একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তিনি সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, তাতে এমন দিন আসবে, যখন পূর্ববাংলাবাসী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে।” এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। সোহরাওয়ার্দী এই দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ভাসানীর সঙ্গে মতপার্থক্য ও দূরত্ব বেড়েই চলে। যার ফলে সংগঠনে একটি আসন্ন বিভক্তির ইঙ্গিত ছিল।

আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ ও ন্যাপ গঠনঃ

১৮ই মার্চ ১৯৫৭ ভাসানী দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠান। আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিব তাঁকে পদত্যাগ না করার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। ২৪শে জুলাই আওয়ামী লীগের সাথে তাঁর সব সম্পর্কের ইতি ঘটে।

২৫শে জুলাই মাওলানা ভাসানী সারা পাকিস্তানের বামপন্থীদের ঢাকায় রূপমহল সিনেমা হলে একটি সম্মেলন ডাকেন। নিজেকে সভাপতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানীকে মহাসচিব করে জাতীয় আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। এরপর থেকে মাওলানা প্রকাশ্যে বামমুখী রাজনীতি অনুসরণ করেন।

১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।

১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন।

১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করেন। চীনের বিপ্লব দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সাত সপ্তাহ চীনে অবস্থান করেন।

২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪, তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে পুনরুত্থিত করেন, এর সভাপতি হন এবং সেই বছরের ২১ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল (COP) গঠনে ভূমিকা পালন করেন।

ভারতের সাথে পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে, তিনি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের চীন-বান্ধব পররাষ্ট্র নীতির জন্য কিছু সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ন্যাপ মস্কোপন্থী এবং বেইজিংপন্থী দুটি পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে যায়, যার নেতৃত্বে মুজাফফর আহমেদ মস্কোপন্থী উপদলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৭-র নভেম্বর-এ ভাসানী চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

পরে তিনি ফাতিমা জিন্নাহর সহায়তায় ১৯৬৮-৬৯ সালে স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন।

১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ আটষট্টির সেই ছাত্র অসন্তোষ গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে।

৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। টাইমের জন্য একটি নিবন্ধে, আমেরিকান সাংবাদিক ড্যান কগিন ভাসানীকে ১৯৬৯ সালের পূর্ব পাকিস্তান গণঅভ্যুত্থানের জন্য কৃতিত্ব দেন, যার ফলে আইয়ুব খানের শাসনের পতন ঘটে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের মুক্তি দেওয়া হয়।

আইয়ুব খানের পতনের পর নতুন করে সামরিক শাসন জারি হয়।

ঘরোয়া রাজনীতি ছাড়া সব ধরণের জাতীয় ও প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন।

এই অবস্থায় সব নেতারা যখন দ্বিধাবিভক্ত, ভাসানী তখনও প্রতিবাদের পথ খুজে নিলেন। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে, প্রথম তিনি কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করেন পাকশিতে। এই সম্মেলনে তিনি কৃষক স্বেচ্ছাসেবক লীগ এর কর্মীদের লাল টুপি পরার রীতি চালু করেন। এরপর প্রকাশ্য রাজনীতির অনুমতি দেয়া হলে সন্তোষ, মহীপুর, ঢাকা, খুলনা ও ময়মনসিংহে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

২৩ থেকে ২৫ মার্চ, ১৯৭০ পর্যন্ত, ভাসানী এবং তার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি টোবা টেক সিং জেলায় একটি আন্তর্জাতিক কিষান সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের সময়, তিনি পাকিস্তান সরকারকে জনগণ ইসলামী সমাজতন্ত্র চায় কিনা তা নির্ধারণের জন্য একটি গণভোট আয়োজনের অনুরোধ করেন। সামরিক সরকার ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে তিনি গেরিলা যুদ্ধের হুমকি দেন।

১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। এস. আখতার এহতিশামের মতে, ভাসানীর ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্ত কার্যকরভাবে তার প্রাক্তন প্রতিপক্ষ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী ভূমিধসের দিকে পরিচালিত করে। পূর্ব পাকিস্তানে কোনো কার্যকর বিরোধিতা ছাড়াই, আওয়ামী লীগ প্রদেশের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়লাভ করে, এটি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করে।

১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানান।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাঃ

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মাওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে বার্তা পাঠান যে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক হারে গণহত্যা চালাচ্ছে। তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবারও আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই।

৭ জুন মওলানা ভাসানী আরেক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।

এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন – ১) তাজউদ্দীন আহমদ, ২) মণি সিংহ, ৩) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, ৪) মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তনঃ

মাওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক হক-কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও মুজিব সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের এর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন এবং মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন,

” আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না। ”

১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫-২২ মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪-এর ৮ এপ্রিল হুকুমতে রাব্বানিয়া সমিতি গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন।

ঐতিহাসিক লং মার্চঃ

১৯৭৬-এর ১৮ই এপ্রিল ভাসানী ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঘোষণা দেন ভারত যদি বাংলাদেশকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তবে তিনি রাজশাহী থেকে ১৬ই মে ফারাক্কার উদ্দেশ্যে লংমার্চ করবেন। সে সময় বাংলাদেশ সরকার অনানুষ্ঠানিকভাবে ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চকে সমর্থন করে। নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. এইচ. খানের দ্বারা রসদ সরবরাহ করা হয়। লংমার্চের জন্য সারাদেশের সর্বস্তরের লাখ লাখ মানুষ রাজশাহীতে আসেন।

নির্দিষ্ট দিনে হাজার হাজার মানুষ সাথে নিয়ে তিনি পায়ে হেটে লংমার্চ শুরু করেন। প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পরদিন দুপুর তারা চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে পৌছান। জায়গাটি ফারাক্কা বাধের কাছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে। এখানে তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে বক্তৃতা করেন।

সেসময় তাঁর বয়স ৯০ বছর। এরপর তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।

মৃত্যুঃ

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাংগাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে সন্তোষ নামক স্থানে পীর শাহজামান দীঘির পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে।

বাংলাদেশে এবং অন্যত্র তার ভক্তরা ভাসানীকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, অসাম্প্রদায়িক এবং বামপন্থী রাজনীতির প্রবক্তা বলে মনে করেন। ভাসানী ২০০৪ সালে বিবিসি কর্তৃক সর্বকালের অষ্টম সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন।

Add a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।