সাবরা-শাতিলা ম্যাসাকার : ইসরাইলি মদদে লেবাননে সংগঠিত ভয়াবহ গণহত্যা

মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া রাষ্ট্র ইসরাইল তার জন্মের পর থেকে যেকোনো মূল্যে ফিলিস্তিনিদের দমন করতে চেয়েছে। এই নিপীড়ন থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ আশেপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু বিদেশে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতা সংগ্রামী বাহিনীগুলোর ঘাঁটি থাকায় সেখানেও ইসরাইলের কালো থাবা গিয়ে হাজির হয়। কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে মুসলিম হত্যা করাই যেন দেশটির একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮২ সালে তেমনি এক গণহত্যার ঘটনায় প্রতিবেশী দেশ লেবাননের শরণার্থী ক্যাম্পের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। এই জগন্য কাজ বাস্তবায়ন করেছিল লেবাননের একটি উগ্র ডানপন্থী খ্রিস্টান রাজনৈতিক সংগঠন কাতেব পার্টি’ এর সশস্ত্র মিলিশিয়ারা। এদের  সাথে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সরাসরি যোগাযোগ ও মদদ ছিল। বিদেশি ফিলিস্তিনিদের তো হত্যা করেছেই, শুধুমাত্র শিয়া মতাবলম্বী হওয়ায় নিজের দেশের মানুষকেও ছাড় দেয়নি তারা।

ঘটনার শুরু যেখানে :

সত্তর-আশির দশকে গৃহযুদ্ধে টালমাটাল লেবাননের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল বেশ জটিল। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিপরীত মতাদর্শের দল/গোষ্ঠীর লোকদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কারান্টিনা ও ডামুর ম্যাসাকার যা ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে কাতেব পার্টি ও তাদের মিত্রদের দ্বারা সিরিয়ান, ফিলিস্তিনি ও কুর্দি জনগোষ্ঠীর উপর সংগঠিত হয়।

লেবাননের গৃহযুদ্ধে সব মিলিয়ে ১৯৭৫-৯০ সালে দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনের দল ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ বা PLO এর ঘাঁটি ছিল দক্ষিণ লেবাননে। ১৯৭০-৮০ সালে প্রায় নিয়মিত গেরিলাদের অবস্থানে বোমা ফেলতো ইসরাইলি বিমানবাহিনী। ৩ জুন, ১৯৮২ সালে ব্রিটেনে নিযুক্ত ইসরাইলি রাষ্ট্রদূত শ্লোমো আর্গভকে হত্যার জন্য চেষ্টা করা হয়। এর পিছনে দায়ী ছিল ইরাক ভিত্তিক PLO এর শাখা আবু নিদাল গ্রুপ। এদের সাথে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন মূলধারার PLO এর আদর্শগত সংঘাত ছিল। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের চেষ্টা অনুমোদন করেননি। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রদূত হত্যাচেষ্টার জের ধরে লেবাননে আরাফাতের PLO এর উপর হামলা চালায় ইসরাইল। মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও ফিলিস্তিনি গেরিলাদের মূলোৎপাটন করতে এই অপারেশন শুরু করে ইসরাইল। শুরু হয় ব্যাটল অফ ওয়েস্ট বৈরুত। তুমুল যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক চাপ ও শর্ত মেনে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ফলে পিএলও যোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ইসরাইলি সেনারা সাবরা-শাতিলা বাদে পশ্চিম বৈরুতের বাইরের অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

ছবিঃ মানচিত্রে লেবাননের রাজধানী বৈরুত

চুক্তি মোতাবেক ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৮২ থেকে পিএলও যোদ্ধারা বৈরুত ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। এই কাজ তদারকি করার জাতিসংঘের মাল্টিন্যাশনাল ফোর্স (MNF) মোতায়েন করা হয়। তাদের সাথে পিএলও এর চুক্তি হয়েছিল যে লেবাননের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের যেকোনো ইসরাইলি আগ্রাসন থেকে তারা নিরাপত্তা দিবে। এরই মধ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন লেবাননের প্রেসিডেন্ট বশির গামালের সাথে দেখা করে তাকে শান্তিচুক্তির জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। এছাড়া বৈরুত থেকে সরে গেলেও পুরো লেবানন থেকে পিএলও গেরিলাদের মূলোৎপাটন করতেও সাহায্য করেননি। ফলে গামাল ইসরাইলিদের চোখের বালিতে পরিণত হন। ১১ সেপ্টেম্বর MNF বাহিনী বৈরুত ত্যাগ করে এবং ১৪ সেপ্টেম্বর প্রচন্ড এক বিস্ফোরণে গামালের রাজনৈতিক কার্যালয় উড়ে যায়! তার নিহত হবার পিছনে মোসাদের হাত রয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। তবে দায়ী ব্যক্তি হিসেবে হাবিব টানিওয়াস নামে এক লেবানিজ খ্রিস্টানকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ছিলেন সিরিয়ান সোশ্যাল ন্যাশনালিস্ট পার্টির সদস্য এবং সিরিয়ান ইন্টিলিজেন্সের একজন এজেন্ট। বিস্ফোরণে গামাল নিহত হওয়ার পরপরই লেবানিজ মুসলিম নেতারা তার সাথে সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেন।

ছবিঃ বাবা পিয়েরে গামালের সাথে বশির গামাল

গামালের রাজনৈতিক দলটি এমনিতেই ছিল উগ্র ডানপন্থী। প্রেসিডেন্ট হত্যার পর কাতেব পার্টি প্রবলভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এদের ‘ফাল্যাংজ’ নামে সাত হাজার সদস্যের একটি সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী ছিল যারা বশির গামালের হত্যাকাণ্ডের পিছনে ফিলিস্তিনিদের হাত রয়েছে বলে বিশ্বাস করতো। তারা তাদের নেতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের অঙ্গীকার করে। ফলে গৃহযুদ্ধে নতুন মাত্রা পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই সুযোগে ইসরাইল এদেরকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর প্ল্যান করে। তাদের হাত ধরেই সাবরা-শাতিলায় সংগঠিত হয় এই জগন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ।

১৫ জুন, ১৯৮২ সালে যুদ্ধ শুরুর ১০ দিনের মাথায় ইসরাইলি মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) আসন্ন যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর চুক্তির শর্ত ভেঙে পশ্চিম বৈরুতের আরেকটু ভিতরে প্রবেশ করবে। তবে তারা ধীরে ধীরে এগুবে এবং ফিলিস্তিনি রিফিউজি ক্যাম্পগুলোতে প্রবেশ করবে না। কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে লেবানিজ খ্রিস্টানদের কাজে লাগানো হবে। ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮২ সালে ইসরাইলি সেনাপ্রধান রাফায়েল এইটান লেবাননের বৈরুতে সরাসরি ফাল্যাংজ হেডকোয়ার্টারে গিয়ে গণহত্যার জন্য প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে আসেন। মিলিশিয়া নেতারা জানান এজন্য তাদের প্রস্তুতি নিতে ২৪ ঘন্টা সময় লাগতে পারে। পরদিন সকালে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পের ২০০ মিটার দূরে আইডিএফ কমান্ড পোস্টের ছাদে সেনাপ্রধানের সাথে মিটিং করেন। সাথে ছিল মোসাদ চীফসহ একাধিক শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা। পরিকল্পনা মোতাবেক সেদিন সন্ধ্যা ছয়টায় পশ্চিম যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে পশ্চিম বৈরুতের আরো ভিতরে প্রবেশ করে। যথারীতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর বিরোধিতা করে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে। জবাবে ইসরাইল জানায়  এই অঞ্চলের শান্তিরক্ষার জন্য এই কাজটি করেছে। সব পক্ষের সাথে আলোচনার আড়ালে পশ্চিম বৈরুতে আইডিএফ এর প্রবেশের গতি ধীর করা হয়। এরই মধ্যে গণহত্যা চালায় ফাল্যাংজ মিলিশিয়ারা। অর্থাৎ চোরকে চুরি করতে নির্দেশ দিয়ে নিজেই পুলিশ সেজেছে ইসরাইল।

যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনি গেরিলারা ইসরাইলিদের জন্য বৈরুত শহরকে ঘিরে মাইন এবং বুবিট্র্যাপের ফাঁদ পেতেছিল। তাদের সাহায্য করায় স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দা ও শরণার্থী শিবিরের উদ্বাস্তুদের প্রতি ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। এদের মাঝেই লুকিয়ে ছিল ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। সাধারণ জনগণের কারণে এদেরকে আলাদা করা যাচ্ছিলো না। কিন্তু PLO এর সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ায় ইসরাইলি আর্মি সরাসরি কিছুই করতে পারছিলো না। এমনকি আটমাসের পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর এই বলে রিপোর্ট দেয় যে পিএলও পক্ষ থেকে কোনোপ্রকার উষ্কানীমূলক কর্মকান্ড করা হচ্ছে না। তাই ইসরাইল ফাল্যাংজ মিলিশিয়াদের দায়িত্ব দেয় এই অঞ্চল থেকে PLO যোদ্ধাদের একেবারে নিঃশেষ করে দেয়ার। ১৯৮২ সালের ১৬-১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে সেই কাজ করতে গিয়ে বেসামরিক লোকজনের উপর গণহত্যা চালায় তারা। ব্যাপারটি সম্পর্কে জানা থাকলেও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ইসরাইলি সেনাবাহিনী।

 

আক্রমণ শুরু :

ইসরাইলি ট্যাংক শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পে গোলা ছোড়ার মাধ্যমে আক্রমণ শুরু হয়। এখানে PLO এর একটি বড়সড় ট্রেইনিং ক্যাম্প ছিল। ইসরাইলিরা সেটিই ধ্বংস করে দেয়। এই ঘটনাকে বৈধতা দিতে এসময় তারা দাবি করেছিল যে তাদের ফরোয়ার্ড কমান্ড পোস্টের দিকে আরপিজি এবং গুলি ছোড়া হয়েছে। এরপরই দেড় হাজার ফাল্যাংজ মিলিশিয়ারা ঝড়ের গতিতে প্রবেশ শুরু করে। এদেরকে অস্ত্র ও গাড়ি দিয়েছিল ইসরাইল সেনাবাহিনী।

মিলিশিয়াদের একাধিক গ্রূপে ভাগ করে ক্যাম্পের এলাকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। মিলিশিয়ারা ইসরাইলি এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিল  “The question we are putting to ourselves is—how to begin, by raping or killing?” খুন নাকি ধর্ষণ – কোনটা আগে করবে সেটা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিল তারা।

ছবিঃ লেবাননে ইসরাইলি সেনাদের এই অভিযানের নাম ছিল অপারেশন স্প্রিং অফ ইউথ

রিফিউজি ক্যাম্পগুলোর সকল পুরুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নারী-শিশুদের ধর্ষণ/হত্যার বিষয়টি যে যার মর্জির উপর ছেড়ে দেয়া হয়। ১৫০ জন মিলিশিয়া নিয়ে এই জঘন্যতম কাজে নেতৃত্ব দেন লেবাননের সাবেক ইন্টিলিজেন্স চীফ এলি হোবেইকা। ফাল্যাংজ এবং ইসরাইল দুই পক্ষেই তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি ছিলেন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের লেবানন শাখার লিয়াজোঁ (দুই পক্ষের যোগাযোগ সমন্বয়কারী) অফিসার। অবাধ্যতার অভিযোগে বরখাস্ত হওয়ার আগে তার পরিবার এবং বাগদত্তা স্ত্রী ফিলিস্তিনি বা তাদের লেবানিজ মিত্রদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি শত্রুর নিরস্ত্র মানুষের সাথে এবার চরম নির্মমতা দেখান। এছাড়া জোসেফ এডি, ডিব আনাস্টা, মাইকেল যোনিনসহ একাধিক ফাল্যাংজ নেতা গণহত্যায় নেতৃত্ব দেন। তাদের সহযোগী হিসেবে সাউথ লেবানন আর্মি নামে আরেকটি দল যোগ দেয় যাদের নেতা ছিলেন শাদ সাদ্দাদ। সব মিলিয়ে অভিযানে অংশ নেয়া মিলিশিয়াদের সংখ্যা আনুমানিক ৩০০-৪০০ জন ছিল। রাতের আধারে গণহত্যা চালাতে যেন সুবিধা হয় সেজন্য ইসরাইলি সেনারা ক্রমাগত ফ্লেয়ার কার্টিজ ফায়ার করে সাবরা-শাতিলার আকাশ আলোকিত করে রেখেছিল। একজন ডাচ নার্স পরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন “The camp was bright like a sports stadium during a football game”

গোটা এলাকাকে লকডাউন ঘোষণা করে মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছিল যেন কেউই পালাতে না পারে। শহরের বেশিরভাগ উঁচু ভবন ছিল ইসরাইলিদের দখলে। তারা সেগুলোর ছাদ থেকে রেডিও কল এবং লেজার রশ্মির মাধ্যমে মিলিশিয়াদের দিক নির্দেশনা দিয়েছিল। এমনকি লেবাননে কুয়েত দূতাবাসের সাত তলা ভবনকেও এই কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। ইসরাইলিদের ধারণা ছিল ২/৩ হাজার সন্ত্রাসী (রিফিউজি) ক্যাম্প দুটোতে রয়েছে। তাদের প্রত্যেককে হত্যার প্রস্তুতি নিয়ে তারা এসেছিল। PLO যোদ্ধারা না থাকায় মিলিশিয়ারা তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়েনি। মাত্র দুজন ফাল্যাংজ আহত হয়েছিল। থমাস ফ্রিডম্যান নামক একজন সাংবাদিক পরদিন ক্যাম্পে প্রবেশের সুযোগ পান। তিনি লাইন ধরে হাত-পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা ব্যক্তিদের দেখতে পান। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই ছিল।

‘গণহত্যা তাদের অগোচরে হয়েছে’ – এটি প্রমাণ করতে মোসাদ একটি রেডিও সার্ভাইল্যান্স পোস্ট সেট করে। তারা ফাল্যাংজ মিলিশিয়াদের রেডিও যোগাযোগ মনিটরিং করছিলো। নিয়ম মোতাবেক সেটি সম্পর্কে হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করা হয় যেন সেখান থেকে গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ আসে। আসলে পরেরদিন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর অগ্রসর হওয়াকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বৈধতা দেয়ার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করেছিল ইসরাইল। একই সঙ্গে সেনাপ্রধানের দেয়া নির্দেশ

মিলিশিয়ারা ঠিকমতো পালন করছে কিনা সেটাও পর্যবেক্ষণ করা ছিল এই সার্ভাইল্যান্স টিমের কাজ। তবে রেডিওতে কথাবার্তা আশেপাশের ইউনিটের ইসরাইলি সেনারাও শুনতে পায়। যেমন লেফটেন্যান্ট ইউল নামে এক তরুণ কর্মকর্তা পরবর্তীতে গঠিত তদন্ত কমিটি (আইওয়াশের জন্য গঠিত) কে বলেন তিনি রেডিওতে শুনেছেন যে একজন মিলিশিয়া কমান্ডার তার হাতে বন্দি ৫০ নারী-শিশুকে কি করবেন নির্দেশ জানতে চাইলে কমান্ডার এলি হোবেইকা রেগে গিয়ে বলেন

 “This is the last time you’re going to ask me a question like that; you know exactly what to do.”

আরেক রিপোর্টে জানা যায় তিনি বলেছিলেন ‘do what your heart tells you, because everything comes from God.’। এসব কারণে PLO যোদ্ধা ও তাদের সহকারীরা ছাড়াও নির্বিচারে বেসামরিক লোকজন হত্যার ঘটনা ঘটে। রেডিওতে ফাল্যাংজ কমান্ডাররা কে কত জন মেরেছে তা নিয়ে আলোচনা করছিলো। এসব কথাবার্তা শুনে মেজর আমোস গিলাদসহ বেশ কিছু চেকপোস্টের ইসরাইলি সেনারা তাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ জানতে চান। তাদেরকে ‘স্ট্যান্ড ডাউন’ অর্থাৎ চুপচাপ বসে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। এসব সেনাদের জানা ছিল না যে এই হত্যাকাণ্ড উপরের মহলের ইশারায় হচ্ছে। পরদিন সকাল আটটায় একটি ইসরাইলি ট্যাংকের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট গ্রাবুয়েসকি তার দুশো গজ দূরে পাঁচ নারী, দুই যুবককে হত্যার দৃশ্য দেখে আবারো ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের কাছে নির্দেশ জানতে চান। তাকে বলা হয়

“We know, it’s not to our liking, and don’t interfere.”

এসব রেডিও কথাবার্তা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের কানেও পৌঁছায়। কেউ কেউ ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবের বিভিন্ন গোপন উৎস থেকে ফাঁস হওয়া তথ্য পেয়ে পশ্চিম বৈরুতে হাজির হন।

ছবিঃ তৎকালীন সংবাদমাধ্যমে গণহত্যার খবর

সকাল এগারোটার মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে গণহত্যার অস্পষ্ট খবর প্রকাশ হতে থাকে। সাংবাদিকরা ইসরাইলি-মার্কিন  কূটনৈতিক, সরকারী কর্মকর্তাদের ঘিরে ধরেন। একেক জন একেক রকম কথা বলতে থাকেন। এরই মধ্যে ইসরাইলি বাহিনীর প্রত্যাহার নিয়ে মার্কিন মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স চীফের সাথে এরিয়েল শ্যারনের বক্তব্য পাওয়া যায়।

“I just don’t understand, what are you looking for? Do you want the terrorists to stay? Are you afraid that somebody will think that you were in collusion with us? Deny it. We denied it”

 

সোজা কথায় তিনি গণহত্যার কথা অস্বীকার করেন। একই সঙ্গে তাকে ফাল্যাংজ মিলিশিয়াদের ব্যবহার করে গণহত্যা চালানো হলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হবে বলা হলে তিনি রেগে গিয়ে বলেন,

“So, we’ll kill them. They will not be left there. You are not going to save them. You are not going to save these groups of the international terrorism.. . If you don’t want the Lebanese to kill them, we will kill them.”

ছবিঃ গণহত্যার নেপথ্য নায়ক এরিয়েল শ্যারন

সেদিন বিকেলে উক্ত ট্যাংক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট গ্রাবুয়েসকি ফাল্যাংজ মিলিশিয়াদের জিজ্ঞেস করেন কেন তারা গর্ভবতী নারীদেরও হত্যা করছে?  জবাবে তারা বলে এরা ভবিষ্যতে যে সন্তান জন্ম দিবে তারাও সন্ত্রাসী হবে। তাই তাদেরকেও হত্যা করা হচ্ছে। সব জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এবং মার্কিন চাপের কারণে ভোর পাঁচটায় মিলিশিয়াদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সেনাপ্রধান রাফায়েল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্যারন নিজেদের মধ্যে আলোচনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ তাদের ধারণার চেয়েও বেশি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহলের চোখে ধুলো দিতে ইসরাইলি আর্মি সাবরা-শাতিলা ক্যাম্প লকডাউন করে নামেমাত্র উদ্ধার অভিযান চালায়।

ছবিঃ নিহতদের লাশ উদ্ধার কার্যক্রম।
ছবিঃ নিহতদের লাশ উদ্ধার কার্যক্রম।

১৯৮৩ সালে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল শেন ম্যাকব্রাইড এর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি সাবরা-শাতিলা ম্যাসাকারের জন্য ইসরাইলকে সরাসরি দায়ী করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং এই ঘটনাকে জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যা লিস্টে তালিকাভুক্ত করে। একই বছর ইসরাইলের কাহান কমিশন নামে আরেকটি তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে বলে যে, ইসরাইলি সেনা নেতৃত্ব গণহত্যা শুরু হওয়ার পর খবর পেয়েও সেটি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিধায় দেশটিকে পরোক্ষভাবে সাবরা-শাতিলা গণহত্যার জন্য দায়ী করে। এর জের ধরে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সাবেক জেনারেল এরিয়েল শ্যারন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ধারণা করা হয় এর পিছনে তার ঔদ্ধত্যপূর্ন বক্তব্যগুলো দায়ী। তবে ইসরাইলে তার কর্মকান্ড প্রশংসা পায়। সাধারণ ইসরাইলীরা সন্ত্রাসী নিধনের গল্প শুনে বাহবা দেয় যা শ্যারনের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। এভাবেই শরণার্থী ক্যাম্পে প্রাণ হারায় হাজারো নিরীহ মানুষ। ধারণা করা হয় এই গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ৪৬০ থেকে ৩,৫০০ জন।

Add a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।